দখল আর দূষণে একাকার বুড়িগঙ্গা

কোন বরফখণ্ড নয়, বুড়িগঙ্গার বুকে নৌযানের ইঞ্জিন চালু হলে এভাবে তৈরি হয় ফেনা, আর বাতাসে ছড়ায় দুর্গন্ধ। ছবি : কমল জোহা খান
কোন বরফখণ্ড নয়, বুড়িগঙ্গার বুকে নৌযানের ইঞ্জিন চালু হলে এভাবে তৈরি হয় ফেনা, আর বাতাসে ছড়ায় দুর্গন্ধ। ছবি : কমল জোহা খান

‘আমরা নদীর পানিতে গোসল করি না। দূর থেকে পানি এনে শইল্যে ঢালি। খাওন তো দূরের কথা।’ ঢাকার সদরঘাটে বুড়িগঙ্গার কোলে নোঙর করা একটি লঞ্চের সারেং আবদুল হালিম আজ শুক্রবার সকালে নদীর কালো দুর্গন্ধময় পানি দেখিয়ে কথাগুলো বলছিলেন।

কারণ জানতে চাইলে ষাটোর্ধ্ব এই মানুষটি নিজের বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলেন, ‘আমরা মাইনষ্যেরাই গাংগডারে পচাইছি। কেউ পায়খানার লাইনের পানি ফালাইতাছি আবার মাটি ফালাইয়া গাংগডারে চাপাইতাছি।’

আবদুল হালিমের কথার সত্যতা মেলানোর জন্য ঢাকার বুকে পুরো বুড়িগঙ্গা নদীর ভ্রমণের প্রয়োজন নেই। নদীর যেকোনো তীরে দাঁড়ালেই একই রকম দৃশ্য দেখা যাবে। দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে গিয়ে নাক চেপে হয়তো প্রাণবায়ু বের হওয়ার অবস্থা হতে পারে

তবে একসময়ের প্রমত্তা বুড়িগঙ্গাকে জানতে-দেখতে আজ নদীটির একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) সংগঠকেরা। সঙ্গে ছিলেন এই প্রতিবেদকও। সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর মোহাম্মাদপুরের বছিলাঘাট থেকে ছোট একটি নৌকায় করে যাত্রা শুরু করেন তাঁরা। পোস্তগোলা হয়ে নেমে পড়েন সদরঘাটে দুপুর একটায়।

তন্ন তন্ন করে বুড়িগঙ্গা নদী দেখার সময় কেবল দখল আর দূষণের চিত্র ভেসে ওঠে। দেখা গেছে, ২০০৯ সালে হাইকোর্টের দেওয়া রায় অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণের নির্দেশনার বেশির ভাগই অমান্য করা হয়েছে। বছিলা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার পর্যন্ত স্থানে সীমানা চিহ্নিত করার খুঁটি বসানো হয়েছে। তা-ও আবার নদীর ঢালে। এরপর বর্তমান বুড়িগঙ্গার প্রায় পাঁচ কিলোমিটারে কোনো খুঁটির নিশানা পাওয়া যায়নি।

বুড়িগঙ্গার পানিতে ভাসছে মরা মহিষ। ছবিটি আজ শুক্রবার তোলা। ছবি : কমল জোহা খান
বুড়িগঙ্গার পানিতে ভাসছে মরা মহিষ। ছবিটি আজ শুক্রবার তোলা। ছবি : কমল জোহা খান

হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, নদীর পাড় থেকে ৫০ মিটার দূরে সীমানা খুঁটি বসানোর কথা জেলা প্রশাসনের।
সদরঘাট পেরিয়ে পোস্তগোলা এলাকায় নদীর পাড়ে ইট রাখা হয়েছে স্তূপ করে। আর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশনের অগণিত পাইপ এসে পড়েছে বুড়িগঙ্গার বুকে। এই লাইনগুলো বেশির ভাগই নদীর আশপাশের শিল্প কারখানার। আবাসিক ঘরবাড়ির পয়োনিষ্কাশনের বোঝাও বইতে হচ্ছে বুড়িগঙ্গাকে। তবে কেবল ব্যক্তি নয়, ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্যের লাইন-পাইপ পড়েছে নদীর বুকে। এ ছাড়া কয়েকটি স্থানে মাটি ফেলে ব্যক্তি উদ্যোগে নদী ভরাট করা হয়েছে। নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে টংঘর। রয়েছে মসজিদও।
দূষিত বুড়িগঙ্গায় এখন আর মাছ নেই। তাই চোখে পড়েনি মাছ ধরার নৌকা। তবে ভেসে থাকতে দেখা গেছে ফুলে-ফেঁপে ওঠা মরা মহিষ আর কুকুর। সঙ্গে দুর্গন্ধময় বাতাস তো আছেই।
বাপার সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন প্রথম আলোকে এ সময় বলেন, ‘কেরানীগঞ্জের চাইতে দখল, ড্রেন বসানো বেশি হয়েছে বুড়িগঙ্গার রাজধানী ঢাকার পাড়ে।’
বাপার দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, বর্জ্যের কারণে নদী দূষিত হচ্ছে, দখলে সংকুচিত হচ্ছে। নদীর নাব্যতা কমে গেছে। বুড়িগঙ্গার উত্পত্তি ধলেশ্বরী নদী থেকে। দখলের মাত্রা এতই বেশি যে, ধলেশ্বরী-বুড়িগঙ্গার সংযোগস্থল এখন খালে পরিণত হয়েছে। তাই ধলেশ্বরীর পানি ঢোকে না এই নদীতে।
এদিকে তুরাগের সঙ্গে যুক্ত থাকায় বুড়িগঙ্গায় এখনো পানি আছে। তবে তুরাগেও বইছে দূষিত পানি।