প্রশাসননির্ভর আ.লীগ

শেখ হাসিনা
শেখ হাসিনা

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন অনেকটাই প্রশাসননির্ভর হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার গত পাঁচ বছরে মাঠপর্যায়ে দলের সাংগঠনিক ভিত মজবুত না হওয়ায় দলীয় কাজে প্রশাসনের সহায়তা নিতে হচ্ছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে শুরু করে সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও দলের অনেক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে গোয়েন্দা সংস্থাকে সম্পৃক্ত করতে হয়েছে। এমনকি দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন, বিদ্রোহী প্রার্থীকে বসিয়ে দেওয়া, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায়ও গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
আওয়ামী লীগের ভেতরে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, ক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকে দলের নেতা-কর্মীদের একটা অংশ সাংগঠনিক কাজের চেয়ে যেকোনো উপায়ে টাকাপয়সা উপার্জনে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে এই সময়ে (২০০৯ ও ২০১২) দুবার কেন্দ্রীয় সম্মেলন করা হলেও মাঠপর্যায়ে দলকে গুছিয়ে তুলতে পারেনি। সদ্যসমাপ্ত উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় যে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে, তা দলের ভেতরে অব্যবস্থাপনার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন অনেক নেতা।
কেন্দ্রীয় কমিটির বাইরে মেয়াদোত্তীর্ণ ৭৩টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ১২টি জেলার সম্মেলন হয়েছে পাঁচ বছরে। প্রায় ৫০০ উপজেলা ও থানা কমিটির মধ্যে সম্মেলন হয়েছে শ খানেক কমিটির। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের ১৫ মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত কমিটি হয়নি। এ সময়ে সাংগঠনিক অনেক সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারেনি দলটি। কেবল দিবসভিত্তিক কর্মসূচি পালন এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কয়েকটি সমাবেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মকাণ্ড।
দলের এ রকম সাংগঠনিক পরিস্থিতি থাকায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের আন্দোলন ও সহিংসতার বিরুদ্ধে মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি; বরং বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘুদের প্রশাসনকে নিরাপত্তা দিতে হয়েছে। এমনকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রেও সরকারের একটি বিশেষ সংস্থাকে ব্যবহার করতে হয়েছে। এরশাদ শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার পর তাঁকে বশে রাখাসহ রওশনের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনা এবং আসন বণ্টনের ক্ষেত্রেও ওই সংস্থাটির বড় ভূমিকা ছিল। কোন আসনে আওয়ামী লীগের কোন প্রার্থী থাকবে বা প্রত্যাহার হবে, সরকারের উচ্চপর্যায়ের সে সিদ্ধান্তও কার্যকর করেন ওই সংস্থার কর্মকর্তারা।
অবশ্য আওয়ামী লীগ প্রশাসননির্ভর দল—এ কথা মানতে রাজি নন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দল প্রশাসননির্ভর বা উপজেলা নির্বাচনে প্রশাসনের সহায়তা নেওয়া হয়েছে বলে যেসব কথা সংবাদপত্রে বের হয়েছে, তা ঠিক নয়। সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে ও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতেই দল চলছে। দলের সিদ্ধান্তও ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, ২০০৯ সালের ৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে দলের নতুন ঘোষণাপত্র প্রচার ও ব্যাখ্যার জন্য কর্মশালা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা, নতুন শিক্ষানীতি প্রচার, পুস্তিকা, বুলেটিন প্রকাশ, সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন অভিযান, সময়সীমা নির্ধারণ করে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌর, থানা ও জেলা সম্মেলন, বিভাগীয় সম্মেলন, উপকমিটি গঠন, সম্পাদকমণ্ডলীর কার্যক্রম নিয়মিতকরণ ও বিভাগীয় সম্পাদকদের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং সাংগঠনিক সম্পাদকদের বিভাগীয় দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে নিয়মিত বুলেটিন প্রকাশ, উপকমিটি গঠন ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে বিভাগীয় দায়িত্ব বণ্টন, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন কমিটির সম্মেলন, তৃণমূল নেতাদের ঢাকায় এনে বর্ধিত সভা এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলন হয়েছে।
২০১০ সালের ১৬ জুলাই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের আরেকটি বৈঠকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনমত গঠনে জেলায় জেলায় সমাবেশ এবং পরে সাতটি বিভাগে মহাসমাবেশ করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু একটি মহাসমাবেশও হয়নি। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো জেলায় সরকারি সফরে গেলে রাজনৈতিক সভা করেছেন।
মাঠপর্যায়ে সংগঠনকে চাঙা করার জন্য শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১২ নভেম্বর থেকে তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেন। ২০১৩ সালের ২২ জুন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে ৭৩টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৪৪টি জেলার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ২০১১ সালের ২২ নভেম্বর জেলা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়কদের কাছে লেখা এক চিঠিতে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা শাখার সম্মেলন শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেন। এর মধ্যে ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন; ৩০ এপ্রিলের মধ্যে উপজেলা ও থানা এবং একই বছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জেলা ও মহানগর কমিটির সম্মেলন শেষ করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়। চিঠিতে তিনি সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন অভিযানের জন্য তাগিদ দেন। চিঠিতে বলা হয়, সদস্যপদ নবায়ন অথবা নতুন করে দলের সদস্যপদ গ্রহণ না করলে কেউ কোনো পর্যায়ের নেতা নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্য নন। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সম্মেলন না হওয়ায় সৈয়দ আশরাফ ২০১২ সালের ১০ জুন দলীয় সব সংসদ সদস্যকে আরেক দফা চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে তাগিদ দেন। কিন্তু এ পর্যন্ত মাত্র ১২টি জেলার সম্মেলন হয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, গ্রামভিত্তিক ১৫০ জন সদস্য সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ঢাকা মহানগরসহ অনেক জেলায় তা শুরুই হয়নি। গত পাঁচ বছরে কয়েক দফা কেন্দ্রীয় নেতাদের সাংগঠনিক সফর কর্মসূচি নেওয়া হলেও তা দায়সারাভাবে পালিত হয়েছে। জেলায় জেলায় বর্ধিত সভা করার কথা থাকলেও ঢাকা বিভাগে তা হয়নি।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে দলকে চাঙা করতে হঠাৎ করেই সহসম্পাদক নিয়োগের হিড়িক পড়ে যায়। সে সময় তিন দফায় প্রায় সাড়ে চার শ সহসম্পাদক নিয়োগ করা হয়। গণহারে এ নিয়োগ নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে সমালোচনা আছে। নির্বাচনের পর নতুন করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ওই সম্পাদকদের আর দলীয় কার্যালয়ে দেখা যায় না। সচিবালয়, নগর ভবন, রাজউক, খাদ্য ভবন, শিক্ষা ভবন, বিদ্যুৎ ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে তদবির ও দেনদরবারেই তাঁদের অনেকে ব্যস্ত থাকেন বলে জানা যায়।