রাতজাগানিয়া মধুর লড়াই

রঙ
রঙ

হ্যাজাক বাতির আলোয় আলোকিত মঞ্চ। সেখানে আসন অলংকৃত করেছেন দুই কবি। সঙ্গে আছেন ঢোলবাদকসহ কয়েকজন বাদ্যযন্ত্রী। মঞ্চের সামনে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন উল্লসিত দর্শক। তাঁদের চোখে কৌতূহল, নানা জিজ্ঞাসা। দুই কবির লড়াইয়ে কে জিতবেন। এ নিয়ে টান টান উত্তেজনা।

মিয়াবিবি,  শৈল্পিক
মিয়াবিবি, শৈল্পিক

ঢোলের বাদ্যির তালে তালে এক কবি গেয়ে উঠলেন, গন্ধম খাইয়া আদমেরে/ স্বর্গ থেকে নামাইলি/ পাপের বোঝায় দুনিয়াটারে/ কেমন নরক বানাইলি। নারীর প্রতি বিদ্বেষ ফুটে উঠেছে কবির চরণে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার অনেকেই হইহুল্লোড়ে মেতে উঠলেন। তাঁদের হর্ষধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে থাকল রাতের আকাশে। এ সময় মঞ্চের আরেক পাশ থেকে অন্য কবি প্রতিবাদ করে উঠলেন, নারী মাতা, নারী কন্যা/ নারী হইল প্রিয়া/ এই দুনিয়া স্বর্গ হইল/ নারীর জীবন দিয়া। উত্তর শুনে হাজারো দর্শকের করতালি। নারী কন্যা, নারী জননী—এ রকম ভাবের কথায় কারও চোখে জল। তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন প্রতি-উত্তরে নারীবিরোধী কবি কী বলেন। এভাবে ছন্দের তালে তালে, গানের সুরে সুরে চলতে থাকে লড়াই। এ এক রাতজাগানিয়া মধুর লড়াই।
কি শহরে কিংবা গ্রামে এ রকম রাত আর কাটাতে পারেন না মানুষ। কবিগানের দিন যেন ফুরিয়ে এসেছে। গ্রাম-বাংলায় বিশেষ করে আমাদের চট্টগ্রামে নববর্ষসহ পৌষপার্বণের মেলাগুলোতে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল কবির লড়াই। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌরাত্ম্যহীন যুগে মানুষের চিত্তবিনোদনের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল এটি। আর তাই কবিগানের কবিয়ালরা সাধারণ মানুষের কাছে পেতেন অসাধারণ মর্যাদা। তাঁদের অনেকের ছিল দেশজোড়া খ্যাতি। তাঁদের পরিচিতি অনেক সময় দেশ ও অঞ্চলকে ছাপিয়ে ও ছাড়িয়ে যেত। কথা উঠত রমেশ শীলের চট্টগ্রাম, নাকি চট্টগ্রামের রমেশ শীল। বিভিন্ন আসরে গান গাইতে গাইতে, কবিতা বলতে বলতে তাঁর নাম এমনভাবে ছড়িয়ে গেল তিনি হয়ে উঠলেন আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের এক কিংবদন্তি। এখনো চট্টগ্রামের মানুষ গর্ব করে বলেন, ‘আঁরা রমেশ শীলর দেশের মানুষ।’

মিরনস
মিরনস

একটা বিষয়কে ধরে মুখে মুখে কাব্য তৈরি করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে দর্শক-শ্রোতার মন জয় করার এই ধারায় রমেশ শীলের আগে আমরা প্রথমেই শুনতে পাই সন্দ্বীপের আজগর আলীর নাম। তিনি এ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন কবিয়াল। তবে চট্টগ্রামে কবিগানের পথিকৃৎ ভাবা হয় কবিয়াল নবীন ঠাকুরকে। ভাষা, সংস্কৃতি আর এখানকার মানুষের জীবনধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনিই প্রথম চট্টগ্রামের নিজস্ব কবিগানের একটা স্বকীয় ধারা তৈরি করলেন। সেই ধারা তৈরি করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর হাত ধরে উঠে এসেছেন রমেশ শীল (১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ-১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ)। কবিগানের এই স্বর্ণযুগে আসর মাতিয়ে রাখতেন দুর্গাচরণ জলদাশ, অপর্ণাচরণ জলদাশ, প্রাণকৃষ্ণ জলদাশ, তারা চরণ দাস, বরদা চরণ দে, গৌবিন্দ চরণ দে, করিম বখস, সুবল ভট্ট, কালা মোহন বাঁশী, চিন্তা হরণ, সারদা বড়ুয়া, হেদায়েত ইসলামসহ আরও অনেক নাম না জানা কবি। তবে এঁদের মধ্যে নিজ প্রতিভার গুনে কবিগানকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন রমেশ শীল।
সমসাময়িক আলোচিত ঘটনা ও রাজনীতিকে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের জাঁতাকলে অতিষ্ঠ মানুষের মনের কথা আর শাসকশ্রেণীর চরিত্র ব্যঙ্গাত্মকভাবে কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে তাঁর জুড়ি ছিল না। রমেশ শীলের পরবর্তীকালে আমরা তাঁরই শিষ্য গোপাল দাস আর ফনী বড়ুয়াকে পাই।
মানুষের ভালোবাসা আর মুগ্ধতাই হচ্ছে কবিয়ালদের প্রধান পুঁজি। জনপ্রিয়তাই তাঁদের প্রধান স্বীকৃতি। আমজনতার হূদয়ের সেই স্বীকৃতি অবশেষে রাষ্ট্রও মেনে নিয়েছে। রমেশ শীল ও ফনী বড়ুয়া এ দেশের সম্মানজনক রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু এই পদক এই স্বীকৃতি কবিগানকে যেন বাঁচিয়ে রাখতে পারল না।
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে কবিগানের উজ্জ্বল ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন নুরুল হুদা, আর এম আলী শেখ, সাধন সরকার. মিলন সরকার, আবদুল লতিফ, কল্পতরু ভট্টাচার্য, চক্রপাণি ভট্টাচার্য, বাবুল দাস, মাহমুদুর রহমান, মিলন শীল, তরুণী সেন দেয়ারী, হরিপদ দেয়ারী, রতন বড়ুয়া, মোস্তাক আহমদ, নুরুল হক, জিয়া উদ্দিন, সুনিল দাস, দিলীপ দাস, এম এ মান্নান, মানিক শীল ও খুকী রানী শীল।
মেলায়, খেলায়, পূজা-পার্বণে, বিয়ের আসরে, নবান্ন উৎসবে অথবা যেকোনো সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাঁদের ডাক আসত। সেই দিন এখন নেই। আর তাই কবিয়ালরাও হারিয়ে যাচ্ছেন। কবিগানের শত শত বছরের ধারায় এ দেশের সাম্প্রতিকতম তারকা কবিভাতৃদ্বয় কল্পতরু ভট্টাচার্য ও চক্রপাণি ভট্টাচার্য। তাঁরা নিবু নিবু প্রদীপটিকে বাঁচিয়ে রাখছিলেন। একুশ শতকের এই অন্তর্জাল, বৈদ্যুতিন মায়ার যুগেও তাঁরা কবিগানের আসর জমাতেন। ২০১৩ সালে এই ভাতৃজুটির একজন চক্রপাণি ভট্টাচার্য চিরকালের জন্য চলে গেলেন। তাঁর ভাই কল্পতরু ভট্টাচার্যও অসুস্থ। বর্তমানে দেশে নেই। চিকিৎসার জন্য ভারত গেছেন। তাঁর পুত্র গায়ক রাজীব ভট্টাচার্য জানালেন, লোকসংস্কৃতির প্রাণ কবিগান নামে একটি বই লিখেছেন তাঁর বাবা। সেটি প্রকাশের অপেক্ষায়। দুই ভাইয়ের জুটির মধ্যে একজন নেই, একজন অসুস্থ। কবিগানের বর্তমান অবস্থাটি যেন প্রতীকী হয়ে ফুটে উঠল দুই ভাইয়ের ঘটনায়।
রাষ্ট্রীয়-সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আমাদের সংস্কৃতির এই উজ্জ্বল ঐতিহ্য কি একেবারেই হারিয়ে যাবে?