মাদ্রাসার উপযোগী করতে পাঠ্যবইয়ে অদ্ভুত পরিবর্তন

সাধারণ শিক্ষার মূল পাঠ্যবইগুলোকে মাদ্রাসা শিক্ষার বৈশিষ্ট্য-উপযোগী করতে গিয়ে বইগুলোর আঙ্গিক ও মৌলিক কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, শিক্ষকনেতা ও বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চাওয়া অনুযায়ী এ পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়া চলছে। সাধারণ বিদ্যালয়ে আগের পাঠ্যবই-ই বহাল থাকবে।
চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা যাতে পিছিয়ে না পড়ে, সে জন্য বাংলা, ইংরেজিসহ সাধারণ শিক্ষার মূল বিষয়গুলো মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তা করতে গিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত জর্জ হ্যারিসনের ঐতিহাসিক ছবিটি বাদ দিতে হচ্ছে। সরিয়ে ফেলতে হচ্ছে লালন শাহের ‘মানবধর্ম’ কবিতা। বাদ পড়ছে বিপ্রদাশ বড়ুয়া ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্য, জ্ঞানদাশের পদ্যসহ আরও কিছু বিষয়।
এই পরিবর্তনের জন্য গত জানুয়ারিতে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে মাদ্রাসার ইবতেদায়ি স্তরের ২১টি ও দাখিল স্তরের ৩১টি পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হয়। তবে নয়টি বইয়ের সংশোধনীর বিষয়ে পরিমার্জন কমিটির সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এরপর বিষয়টি স্টিয়ারিং কমিটির সভায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি উপস্থাপন করা হয়। মাদ্রাসা বোর্ড ও এনসিটিবির চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা এই কমিটির সদস্য।
স্টিয়ারিং কমিটির সভার একটি সূত্র জানায়, বিষয়গুলো স্পর্শকাতর হওয়ায় একধরনের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছে কমিটি। মাদ্রাসা-পক্ষকে খুশি করতে কিছু সুপারিশ গ্রহণ করা হয়েছে, আবার কিছু সুপারিশ বাদও দেওয়া হয়েছে।
এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাদ্রাসা শিক্ষার বৈশিষ্ট্য-উপযোগী করতে গিয়ে নয়টি বইয়ে এমন কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা পাঠ্যবইয়ের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ও সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে আরবি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বইগুলো মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড নিজের মতো করেই সাজিয়েছে।
পরিমার্জন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. আবুল কাসেম মিয়া প্রথম আলোকে জানান, মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে কিছু পরিবর্তনের কাজ চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এগুলো কারও একক সিদ্ধান্ত নয়, সবাই মিলে আলাপ-আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এনসিটিবিতে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত মো. আবুল কাসেম মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বলেন, শিক্ষার দুই স্তরের মূল বিষয়গুলো একই রকম হওয়া উচিত বলে সবাই মনে করেছেন। তার পরও বাস্তবতার নিরিখে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়েছে।
আগামী বছর (২০১৫) থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বাংলা, ইংরেজিসহ মূল বইগুলো ইবতেদায়ি ও দাখিল স্তরে পড়ানোর সিদ্ধান্ত আছে। এ লক্ষ্যে প্রতিটি পাঠ্যবইয়ের একটি পরিমার্জন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির তিন সদস্যের মধ্যে ছিলেন একজন করে শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, এনসিটিবির বিষয় বিশেষজ্ঞ এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের মনোনীত বিশেষজ্ঞ। পরিমার্জন কমিটির প্রস্তাব পর্যালোচনা করে স্টিয়ারিং কমিটি এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন তা জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সভায় উপস্থাপন করা হবে।
এসব পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে পেরে এনসিসিসির সদস্য ছিদ্দিকুর রহমান বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কলকাতার মাদ্রাসায় বিপুলসংখ্যক হিন্দু ছাত্রছাত্রী পড়ে। সেখানকার মাদ্রাসার বইয়ে অন্য ধর্মের লেখক, ভিন্ন ধর্ম নিয়ে লেখা আছে। এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়।
জর্জ হ্যারিসনের ছবি বাদ, লেখা থাকবে: মাধ্যমিক স্তরে ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা জর্জ হ্যারিসনের ছবিসহ ‘দি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ লেখাটি পড়বে। কিন্তু মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ওই লেখাটির বদলে ইসলামি সংগীত, হামদ ও নাত পড়তে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে পরিমার্জন কমিটি। এ নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়।
তিন সদস্যের পরিমার্জন কমিটি এমন প্রস্তাব দিলেও স্টিয়ারিং কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও ‘দি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ পড়বে। তবে গিটার বাজিয়ে গান গাওয়া অবস্থায় তোলা শ্মশ্রুমণ্ডিত ঝাঁকড়া চুলের জর্জ হ্যারিসনের ঐতিহাসিক ছবিটি মাদ্রাসার বইয়ে থাকবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত জর্জ হ্যারিসনের নাম। তাঁর ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গানটি নিয়ে এমন হাস্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা জেনে নিশ্চয়ই তাঁর ছবিটি দেখার কৌতূহল শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা দেবে।
কিশোরী হিজাব পরবে, কিশোর পায়জামা: বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা এবং পঞ্চম শ্রেণীর ইংরেজি বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্টিয়ারিং কমিটি। তৃতীয় শ্রেণীর আমার বাংলা বই-এর প্রচ্ছদ চিত্রে এক কিশোর হাফপ্যান্ট পরে নৌকা বাইছে, নৌকায় বসে এক কিশোরী শাপলা ফুল তুলছে। মাদ্রাসার বইয়ে এই প্রচ্ছদ পরিবর্তন করে কিশোরকে পায়জামা পরানো হবে। কিশোরীর মাথায় হিজাব দেওয়া হবে, তার হাফ হাতা জামাটি ফুল হাতা করা হবে।
পঞ্চম শ্রেণীর ইংরেজি বইয়ের প্রচ্ছদে ফুল, পাখি, প্রজাপতি ও কাশবন রয়েছে। এর ভেতর নৌকা বাইছে এক কিশোর, নৌকার অপর প্রান্তে ফ্রক পরা এক কিশোরী বসা। এই চিত্রটিও মাদ্রাসা শিক্ষার উপযোগী করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদচিত্রে এক গ্রামীণ নারী পানির কলসি নিয়ে ফিরছেন। তাঁর মাথায় ঘোমটা দেওয়া। পাশে আরেক নারী নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়ানো। কিন্তু তাঁর ঘাড়ের পাশ দিয়ে সামান্য পিঠ দেখা যায়। শিল্পীর আঁকা পিঠের এই অংশটিও ঢেকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
লালন শাহের পরিবর্তে ফররুখ আহমদ: অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে একটি পদ্যের শিরোনাম ‘মানবধর্ম’। এটি লালন শাহের লেখা। প্রথম লাইন হচ্ছে, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।’ কবিতা পাঠের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এই পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বুঝতে সক্ষম হবে যে, ধর্ম বা সম্প্রদায়গত পরিচিতির চেয়ে মানুষ হিসেবে পরিচয়টাই বড়। শিক্ষার্থীরা জাত-পাত বা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বা মিথ্যে গর্ব করা থেকে বিরত থাকবে।’ (পৃষ্ঠা-৭১)
বিশেষজ্ঞ কমিটি এই কবিতার পরিবর্তে কবি ফররুখ আহমদের পদ্য ‘মেঘ বৃষ্টি আলোর দেশে’ প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব দেয়। স্টিয়ারিং কমিটি ওই প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
মংডুর পথে বাদ, মদিনার পথে প্রতিস্থাপন: অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা পড়বে বিপ্রদাশ বড়ুয়ার গদ্য ‘মংডুর পথে’। বিশেষজ্ঞ কমিটি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ওই লেখাটি পড়তে দিতে চায় না। তারা মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর ‘মদিনার পথে’ লেখাটি প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করেছে। এই সুপারিশ অনুমোদন করেছে স্টিয়ারিং কমিটি।
ভূত ও আছর: বিস্ময়কর হলেও সত্য, পরিমার্জন কমিটি অষ্টম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তৈলচিত্রের ভূত’ গদ্যটির শিরোনাম পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে। তারা ‘ভূত’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘তৈলচিত্রের আছর’ নামকরণের প্রস্তাব করে। তবে স্টিয়ারিং কমিটির একজন সদস্য সভায় জানান, কোনো লেখকের দেওয়া শিরোনাম পরিবর্তন করা যায় না। তাই এই কমিটির প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়নি।
জ্ঞানদাশের পরিবর্তে মুহাম্মদ সগীর: নবম-দশম শ্রেণীর একটি পদ্যের শিরোনাম ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু’। এটি লিখেছেন জ্ঞানদাশ। এর পরিবর্তে বিশেষজ্ঞ কমিটি মুহাম্মদ সগীরের লেখা ‘বন্দনা’ পদ্যটি অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে।
ব্রতচারী নৃত্য বাদ: সপ্তম শ্রেণীর শারীরিক শিক্ষা বইয়ে ব্রতচারী নৃত্যের সংজ্ঞা দেওয়া আছে। কিন্তু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ব্রতচারী নৃত্য বিষয়ে জানতে দিতে নারাজ বিশেষজ্ঞ কমিটি। কমিটির পক্ষ থেকে ব্রতচারী নৃত্যের সংজ্ঞা বাদ দিয়ে লোকজ ব্যায়ামের সংজ্ঞা প্রতিস্থাপন করতে বলা হয়েছে। স্টিয়ারিং কমিটি তা অনুমোদন করেছে।
বইটির সপ্তম পৃষ্ঠায় ব্রতচারী নৃত্যের সংজ্ঞায় বলা আছে, ‘শারীরিক ব্যায়াম ও সুন্দর দেহ গঠনের জন্য চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোকনৃত্য দ্বারা সেই অঞ্চলের কৃষ্টি, প্রথা প্রভৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়। এতে ছাত্রছাত্রীদের একদিকে যেমন চিত্তবিনোদন হয়, অপরদিকে বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষ্টি বিষয়ে ধারণা লাভ করে। বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগীতির মাধ্যমে যে লোকনৃত্য করা হয়, এসবই হলো ব্রতচারী কার্যকলাপ বা লোকনৃত্য।’
এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, ব্রতচারী নৃত্যের এই সাধারণ সংজ্ঞা পরিবর্তন করে লোকজ ব্যায়ামের সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করার কারণটি হাস্যকর।
পরিমার্জন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত মাদ্রাসা শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদাররেছিনের মহাসচিব শাব্বির আহমেদ মোমতাজি প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ শিক্ষা জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার জন্য। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা শুধু মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য। তাই যেসব বিষয় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সাধারণ শিক্ষার বইগুলো মাদ্রাসায় পড়ানোর সিদ্ধান্তটি সরকারের হলেও এগুলো মাদ্রাসা শিক্ষার উপযোগী করার কাজ করেছে মূলত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এনসিটিবি এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের হাতে বিষয়টি এখনো পৌঁছায়নি। তবে এনসিটিবির পক্ষ থেকে জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সভা ডাকতে শিক্ষাসচিবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।