ভয়ংকর সেই ৩৫ ঘণ্টা

আবু বকর সিদ্দিক গতকাল বিকেলে তাঁর কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় হামিদ ফ্যাশনে গেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম (পাঞ্জাবি পরা) এবং অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা । ছবি: প্রথম আলো
আবু বকর সিদ্দিক গতকাল বিকেলে তাঁর কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় হামিদ ফ্যাশনে গেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম (পাঞ্জাবি পরা) এবং অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা । ছবি: প্রথম আলো

‘ওই বাড়িতে আমাকে দুজন পাহারা দিত। তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বাড়িটি কার, কারা এখানে আসে, থাকে। উত্তরে একজন বেশ ভয়ে ভয়ে জানিয়েছিল, “এখানে আপনার মতোই অনেককে নিয়ে আসা হয়। কাউকে মেরে ফেলা হয়, আবার কাউকে তিন-চার দিন রাখার পর ছেড়ে দেওয়া হয়।”’
কথাগুলো বলছিলেন অপহরণের ৩৫ ঘণ্টা পর মুক্ত আবু বকর সিদ্দিক। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডের বাসভবনে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন শেষে তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোর একান্তে কথা হয়। হাতে সামান্য আঘাতের চিহ্ন আর শরীরজুড়ে ক্লান্তি সামলে সেই ভয়ংকর বন্দিজীবনের বর্ণনা দেন তিনি। এ সময় কিছুক্ষণ পাশে ছিলেন তাঁর স্ত্রী বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী, ম্যাগসাইসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
অপহরণ করে যে বাড়িটিতে রাখা হয়, সেটি কেমন ছিল—জানতে চাইলে আবু বকর সিদ্দিকের চেহারায় কিছুটা আতঙ্কের রেশ ফুটে ওঠে। সেই ভয়ংকর ৩৫ ঘণ্টার মধ্যে কয়েক মিনিটের জন্য চোখের বাঁধন খুলে দেওয়ার কথা স্মরণ করেন তিনি। টয়লেটে যাওয়ার জন্য চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, বাড়িটিতে কয়েকটি কামরা ছিল। একটিতে খাট ও কার্পেট ছিল। তবে মনে হয়েছে, এটি কোনো পারিবারিক বাসা নয়।
দুঃসহ সেই দিনের কথা বলতে গিয়ে কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে ওঠেন আবু বকর। বলেন, ‘একবার অল্প সময়ের জন্য মনে হয়েছিল, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। তখন স্ত্রী-সন্তানদের মুখ কল্পনায় ভেসে উঠেছিল।’ অপহরণের ৩৫ ঘণ্টা পর মুক্ত আবু বকর সিদ্দিক যখন এ কথা বলছিলেন, তখন ক্ষণিকের জন্য তাঁর চোখের কোণে জলের রেখা দেখা গেল।
অপহরণের পর আপনাকে কোথায় কীভাবে নেওয়া হলো, কেমন ছিল জায়গাটি? জবাবে আবু বকর ধীরস্থির ভঙ্গিতেই বললেন, ‘অপহরণের পর আমাকে যে স্থানটিতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে পৌঁছাতে আনুমানিক সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগে। এলাকাটি কিছুটা উঁচু-নিচু মনে হয়েছিল।’
যাওয়ার পথটি কেমন ছিল? আবু বকর জানালেন, ওই বাড়িতে যেতে মনে হয়েছে, দুবার ফেরি পার হয়েছে। গাড়িটি উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে গেছে, তাই মনে হয়েছে এটি গাজীপুর বা কালীগঞ্জের কোনো স্থান হবে। তবে কখনো হাইওয়ে, আবার কখনো ছোট সড়ক ধরে গাড়িটি এগোচ্ছিল বলে মনে হয়েছে।
আবু বকর অপহূত হন বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে ফতুল্লার ভূঁইগড় এলাকা থেকে। সেখান থেকে তাঁকে ওই বাড়িতে পৌঁছতে সময় লেগেছিল সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো। তিনি বলেন, ‘আমাকে তুলে নেওয়ার পর গোপন আস্তানায় পৌঁছার আগে অপহরণকারীরা দুই দফা গাড়ি বদল করেছে। আমার হাত-পা-চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসের সিটে ফেলে রাখে ওরা। ফলে বুঝতে পারছিলাম না কোথায় যাচ্ছি। মনে হলো, একটি ফেরি পার হওয়ার পর গাড়িটি বদল করা হলো, তখন চারজন অপহরণকারী নেমে যায়।’ গাড়িটি কোথাও টোল দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিল, এমনটা তাঁর মনে হয়নি। তখন তিনি খুব ‘নার্ভাস’ ছিলেন, তাই সবকিছু মনে করতে পারছেন না বলে জানান।
অপহরণকারীদের বেশির ভাগের বয়স ৩৫-৩৬ হবে, সবাই বেশ সুঠামদেহী। একজন ছাড়া বাকি সবার উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো হবে। এদের মধ্যে একজন দলনেতা ধরনের ছিল, বয়স ৪০-এর মতো। তারা একে অপরকে ‘তুই তুই’ সম্বোধন করছিল। তবে এদের সবার বাড়ি একই এলাকায় না, এটা বোঝা গেল ওদের ভাষা শুনে।
আবু বকর আরও বললেন, ‘উঁচু স্থানের ওই বাড়িতে নিয়ে রাখার পর আমাকে দেখাশোনা করার জন্য দুজন নিয়োজিত ছিল। একজন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিল। দলনেতা ধরনের লোকটি চলে যাওয়ার পর ওই দুজন আমাকে বাথরুমে যেতে দেয়। রাতে গরুর মাংস ও দিনে মুরগি দিয়ে ভাত এবং সকালে পাউরুটি-কলা খেতে দেয়।’ এসব কথা বলতে বলতে কিছুটা সময়ের জন্য স্মৃতি হাতড়ানোর মতো করে আবু বকর বলতে থাকেন, ‘ওরা আমাকে মামা বলে ডাকত। আমার সঙ্গে ওদের ব্যবহার ভালোই ছিল। মেঝেতে ঘুমানোর জন্য আমাকে দুটি গামছা দেয়। সেখানে বেশ কয়েক ঘণ্টা আমি ক্লান্তি আর আতঙ্কের মধ্যে আধো ঘুমে কাটিয়েছিলাম। দুজনের একজন প্রথম রাতে কানে কানে বলল, “মামা, চিন্তা কইরেন না। আপনারে মারবে না। আপনার স্ত্রীর সঙ্গে মনে হয় কারও জমিজমা নিয়ে ঝামেলা আছে। আপনারে দুই দিন রাইখা ছাইড়া দিব।”’
ওই বাড়িতে আবু বকর যখন পৌঁছান, তার কিছুক্ষণ পর পাশের মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছিল। নিজের উচ্চ রক্তচাপ সমস্যার কথা জানালে অপহরণকারীরা কিছুক্ষণের মধ্যেই ওষুধ নিয়ে আসে। এ কথা জানিয়ে আবু বকর বলেন, ‘সেখানে নেওয়ার পর তারা আমার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি। প্রথমে আমাকে যে কক্ষে নিয়ে রাখা হয়, সেখানে টেলিভিশন ছিল। একসময় টিভির খবরে রিজওয়ানার কণ্ঠ শোনা যাওয়ামাত্রই ওরা চ্যানেল পরিবর্তন করছিল। চোখ বন্ধ থাকায় আমি দেখতে পাইনি। পরদিন (বৃহস্পতিবার) সকালে দলনেতা গোছের লোকটি এসে বলল, “আপনার পক্ষে তো পুরা দেশ নেমে পড়ছে। এখন তো আপনারে মারলেও বিপদ, বাঁচাইয়া রাখলেও বিপদ।”’
আবু বকরের পকেটে ১৫ হাজার টাকা, হাতে একটি সোনার চেইনের মধ্যে তজবি বাঁধা ও আঙুলে একটি সোনার আংটি ছিল। অপহরণকারীরা শুরুতেই এসব কেড়ে নেয়। গাড়ি দিয়ে নেওয়ার সময় ওরা বলছিল, অনেক টাকা পাওয়া যাবে। আবার ছেড়ে দেওয়ার আগে দলনেতা গোছের লোকটি বলে, ‘তোকে ছেড়ে দিতে পারি, তবে একটি নম্বর দিব, যেখানে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বললে অবশ্যই পাঠাবি।’ কিন্তু এসব কথার মধ্যে তেমন জোর ছিল না। তাঁর মনে হচ্ছিল, এমনিতেই তারা এসব কথা বলেছে।
ছেড়ে দেওয়ার আগ মুহূর্তটি সম্পর্কে আবু বকর সিদ্দিক জানান, রাতে দলনেতা এসে বাড়িটির ওই দুই তদারককারীর সঙ্গে কথা বলছিল। তাদের কথায় মনে হচ্ছিল, মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এদের মধ্যে একজন এসে বলল, ‘পুরো এলাকা পুলিশ ও র‌্যাব তল্লাশি চালাচ্ছে। খুঁজতে খুঁজতে এখানেও চলে আসতে পারে।’
আবু বকরের জবানিতে আরও জানা গেল, রাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে গাড়িতে তুলে ঘণ্টা দেড়েক পর একটি জায়গায় নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেখানে গাড়ি থামিয়ে চোখ থেকে কাপড় খুলে দেওয়ার সময় তাঁকে বলা হয়, ‘পেছনের দিকে তাকাবি না। সোজা হেঁটে সামনে যাবি।’
‘পরে জানতে পারি, এটি মিরপুর ১ নম্বর আনসার ক্যাম্পের সামনের রাস্তা। সেখান থেকে প্রথমে রিকশা ও পরে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে বাসার উদ্দেশে রওনা হই। এর পরের ঘটনা তো আপনাদের সবারই জানা।’ স্মিত হেসে বলেন আবু বকর।