বিজ্ঞানে অনাগ্রহ, কমছে শিক্ষার্থী

শিক্ষার্থী কমার চিত্র
শিক্ষার্থী কমার চিত্র

অষ্টম শ্রেণী থেকে ওপরের ধাপগুলোতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী দ্রুত কমছে। বিজ্ঞানের প্রতি এই অনাগ্রহ গ্রামাঞ্চলের স্কুল-কলেজগুলোতে আরও বেশি প্রকট। কিছু অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া শহরেও বিজ্ঞানের গণ্ডি ছোট হয়ে আসছে।
২০০৯ সালে অষ্টম শ্রেণী থেকে ২০১৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা— এই পাঁচ বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিজ্ঞান কীভাবে দূরে চলে গেছে, সেই চিত্র উঠে এসেছে খোদ সরকারের তথ্য-পরিসংখ্যানে।
সরকারি ও বেসরকারি পৃথক চারটি প্রতিবেদন বলছে, শিক্ষার বিভাগভিত্তিক স্তরের শুরুতেই বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কম থাকছে, পরের ধাপগুলোতে তা ক্রমাগত কমছেই। সেই তুলনায় বাণিজ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে।
গত চার বছরে দেখা গেছে, মাধ্যমিকে প্রায় ২২ শতাংশ ও উচ্চ-মাধ্যমিকে ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বিজ্ঞান পড়ছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক সম্মান পর্যায়ে এই সংখ্যা মাত্র ১১ শতাংশ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তা ৩১ শতাংশ।
অষ্টম থেকে দ্বাদশ, যেভাবে বিজ্ঞানের পতন: বিজ্ঞানে শিক্ষার্থী কমার বিষয়ে ২০১১ সালে সাতটি বিভাগে ১৪০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জরিপ চালায় বেসরকারি সংগঠন ফ্রিডম ফাউন্ডেশন। জরিপে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তারা কোন বিভাগ নিতে চায়। ৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছিল, বিজ্ঞান পড়বে। কিন্তু বিভাগ পছন্দের সময় তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়। জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের পেছনে ছিল পরীক্ষার ফলাফল, শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রভাব।
জরিপের এমন চিত্র শিক্ষাবিষয়ক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশন ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসেও (ব্যানবেইস) উঠে এসেছে। সংস্থাটির পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে অষ্টম শ্রেণীতে ২০০৯ সালে শিক্ষার্থী ছিল ১৪ লাখ ৫১ হাজার। নবম শ্রেণীতে উঠেই তারা বিভাগ পছন্দ করে। তখন ওই শ্রেণীতে সাড়ে ১২ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞান নেয় দুই লাখ ৪০ হাজার, যা মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৯ শতাংশ। এক বছর পর মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে ঝরে যায় ২৪ হাজার, অকৃতকার্য হয় আরও ৭৮ হাজার। এভাবে ধাপে ধাপে কমে পাঁচ বছরের মাথায় ২০১৩ সালের উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থী ছিল এক লাখ ৩৮ হাজার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞান চর্চার দেশে জ্ঞানের টুকরো জিনিসগুলো কেবলি ঝরে ঝরে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে চিত্তভূমিতে বৈজ্ঞানিক উর্বরতার জীবধর্ম জেগে উঠতে থাকে। তারই অভাবে আমাদের মন আছে অবৈজ্ঞানিক হয়ে।’ (ভূমিকা, বিশ্বপরিচয়)
শিক্ষার গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহে ভাটা পড়ার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেই বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ প্রথম আলোকে বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, বিজ্ঞান এখন বিজ্ঞানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরও আকৃষ্ট করতে পারছে না। তাঁর মতে, শিক্ষার্থী ও তরুণদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করতে চাইলে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ থাকতে হবে। তাদের স্বপ্ন দেখাতে হবে, উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
শুরুতেই ভর্তি কম: ব্যানবেইস বলছে, মাধ্যমিকে ২৪টি বিষয়ের মধ্যে আবশ্যিক ছয়টি বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সমান। কিন্তু বিভাগভিত্তিক শিক্ষার্থী বিজ্ঞানে বেশ কম। ২০১২ সালে নবম শ্রেণীতে পদার্থবিদ্যায় দুই লাখ ৬৮ হাজার, রসায়নে দুই লাখ ৬৯ হাজার, জীববিদ্যায় দুই লাখ ৫৬ হাজার এবং উচ্চতর গণিতে এক লাখ ৫৪ হাজার শিক্ষার্থী ছিল। একই সময়ে ইতিহাস ও ভূগোলে প্রায় পাঁচ লাখ, বাণিজ্যনীতিতে তিন লাখ ৯৭ হাজার শিক্ষার্থী ছিল।
ফেনীর সোনাগাজী বালিকা পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকার একটি কলেজে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছে শিপ্রা সোম। মাধ্যমিকে তার ব্যাচে ৮০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞান পড়েছে আটজন। শিপ্রা জানায়, মফস্বলে বিজ্ঞান ও গণিত পড়ানোর মতো শিক্ষক কম। যাঁরা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই পুরোনো ও বয়স্ক। তাঁরা এখনকার পাঠ্যক্রমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছেন না।
১১ বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের চিত্র: গত ১১ বছরে (২০০৩-২০১৩) মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী কমেছে গড়ে ১১ শতাংশ, উচ্চমাধ্যমিকে কমেছে ৫ শতাংশ।
অথচ সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষা-নীতিতে বলা হয়েছে, ‘বিজ্ঞানশিক্ষাই একটি জাতিকে দ্রুত তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে।’ শিক্ষা-নীতিতে বিজ্ঞানশিক্ষার অগ্রগতির জন্য প্রাথমিকে চারটি, মাধ্যমিকে চারটি, উচ্চশিক্ষায় ছয়টি কৌশল নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু গত প্রায় তিন বছরে এসব কৌশলের কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি।
বাণিজ্যে শিক্ষার্থী বাড়ছে: ব্যানবেইসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আশির দশকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান ও মানবিকের শিক্ষার্থী ছিল প্রায় সমান। তখন ব্যবসায় শিক্ষা চালু হয়নি। আর এখন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী এক-পঞ্চমাংশের কাছাকাছি।
১৯৯৬ সালে মাধ্যমিক স্তরে ব্যবসায় শিক্ষা চালুর পর থেকে ক্রমে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমতে থাকে। ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী প্রায় ২২ শতাংশে স্থির ছিল। অথচ ওই চার বছরে বাণিজ্যের শিক্ষার্থী বেড়ে ৩৪ থেকে ৩৭ এবং মানবিকের শিক্ষার্থী কমে ৪৩ থেকে ৩৯ শতাংশ হয়েছে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে ১ শতাংশ কমছে: বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানশিক্ষার্থী বছরে গড়ে ১ শতাংশ কমছে। কমিশনের ২০০৬ সালের হিসাবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানশিক্ষার্থী ছিল ১৭ শতাংশ। ২০১২ সালে তা কমে হয়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। ২০১২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর ৪২ শতাংশই ব্যবসা প্রশাসনে পড়েছেন।
শিক্ষাবিদ জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার পরও এ দেশে বিজ্ঞানশিক্ষার এতটা খারাপ অবস্থা ছিল না। কিন্তু এখন বিজ্ঞান শুধুই কমছে, এটা ঠেকানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সে রকম কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
বিষয়টি শুধুই আলোচিত: বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার বিষয়টি কয়েক বছর ধরে আলোচিত হলেও সরকারের এ বিষয়ে বড় কোনো উদ্যোগ নেই। জাতীয় শিক্ষানীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনীতি এবং বিজ্ঞানশিক্ষা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি—এই ত্রিমুখী উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞানশিক্ষার সমস্যা চিহ্নিত করা ও সমাধানের উপায় খোঁজা। তবে এতে বিজ্ঞানশিক্ষার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিজ্ঞানের মৌল বিষয়সমূহে ছাত্রসংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ায় দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ব্যাহত হতে পারে মর্মে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, বিজ্ঞানশিক্ষা যে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে এসেছে, তাতে বিজ্ঞান পড়তে উৎসাহ জোগাতে বিশেষ বৃত্তি দিতে হবে।
 কাল পড়ুন শেষ পর্ব
গ্রামের স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান খুলতে ভয়