ক্ষতিপূরণের জন্য অপেক্ষা লজ্জার

রানা প্লাজা ধসের পর পেরিয়ে গেছে একটি বছর। এখনো ‘পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্ষতিপূরণ’ পাননি বিয়োগান্ত ওই ঘটনার শিকার হওয়া লোকজন। ক্ষতিপূরণের জন্য ভাগ্যবিড়ম্বিত এসব লোকের অপেক্ষায় থাকাটা সবার জন্য ‘লজ্জাজনক’ হবে বলে মনে করে আইএলও।
গতকাল বৃহস্পতিবার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনার এক বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের আলোচনা সভায় এ মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উপমহাপরিচালক গিলবার্ট ফসুন হাংবো।
ওই অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত গারবেন ডি সং ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম আনা দ্রুত ও ন্যায্যভাবে এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় তাঁরা এ অভিমত দেন। শ্রম মন্ত্রণালয় ও আইএলও যৌথভাবে ‘রানা প্লাজার এক বছর পর: অগ্রগতি ও সামনে এগোনোর পথ’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে গত বছরের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর গত এক বছরে তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা ও শ্রমিক অধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতির খতিয়ান তুলে ধরেন শ্রম ও কর্মসংস্থানসচিব মিকাইল শিপার।
আইএলওর এ-দেশীয় পরিচালক শ্রীনিবাসা রেড্ডিও পোশাকশিল্পের গত এক বছরের অগ্রগতির পাশাপাশি আগামী দিনের করণীয় সম্পর্কে একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন তাঁর বক্তব্যে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের এ পর্যন্ত ২২ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। ২০০৬ সালের শ্রম আইন ও আইএলও সনদ (কনভেনশন) অনুযায়ী নিহত ও আহত মিলিয়ে তিন হাজার ৬০০ জনকে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। রানা প্লাজা ধস হলো সতর্কবার্তা। সরকার গঠিত ত্রিপক্ষীয় কমিটির মাধ্যমে চলতি বছরের মধ্যে সব তৈরি পোশাক কারখানা পরিদর্শন শেষ হবে। শ্রম আইনের সংশোধনীতে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আইএলওর উপমহাপরিচালক গিলবার্ট ফসুন হাংবো বক্তব্যের শুরুতেই ক্ষতিপূরণ নিয়ে তাঁর হতাশা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কঠিন হলেও আজ এখানে দাঁড়িয়ে বলতে হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়নি। এটা সবার জন্য লজ্জাজনক। গিলবার্ট ফসুন বলেন, গত এক বছরে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এখন কারখানা পরিদর্শক নিয়োগ-প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। পুরোপুরি শেষ করতে হবে ক্ষতিপূরণ ও শ্রম আইন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও।
যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন বলেন, ‘বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যাপক সমৃদ্ধি আমাদের কাম্য। তবে মানুষের জীবনের বিনিময়ে এ সাফল্য আসুক সেটা আমরা চাই না। রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দ্রুততা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম আনা বলেন, আজকের প্রতিবেদনগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে এক বছর পরও

এখন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অনেকেই দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। তাই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দ্রুত ও পুরোপুরি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আহ্বান জানাই। রানা প্লাজা ধসের এক বছর পূর্তিতে ভেবে দেখার সময় হয়েছে কতটা অর্জন হয়েছে আর কতটা করার বাকি আছে। তিনি অনিবন্ধিত কারখানা, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগের মতো সমস্যা মোকাবিলার পাশাপাশি সব কারখানায় শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করার তাগিদ দেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা বলেন, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের গুণগত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে রানা প্লাজার গুরুত্ব অব্যাহত থাকবে। পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে গত এক বছরে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তিনি শ্রমিকদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও ন্যায্য মর্যাদা দেওয়া এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার স্বার্থে কণ্ঠ তুলে ধরা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেন।
কানাডার হাইকমিশনার হিদার ক্রুডেন বলেন, গত এক বছরে তৈরি পোশাকশিল্পের পরিস্থিতির অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তবে পোশাকশিল্পের পরিস্থিতির বিশ্বাসযোগ্য ও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে কারখানা পরিদর্শক নিয়োগ শেষ করা ও শ্রমিকদের হয়রানি বন্ধের মতো বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া উচিত।
তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম জানান, কারখানা পরিদর্শনের ক্ষেত্রে বিজিএমইএ ন্যূনতম ছাড় দেবে না। কোনো কারখানাকে বন্ধ করতে বলা হলে তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। তিনি মনে করেন, পোশাক কারখানার মালিকেরা এখনো ৩০ বছর আগের ধ্যানধারণায় রয়েছেন। এটা বদলাতে হবে।
বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর সংস্কারমূলক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এই খাতটি। অগ্নিকাণ্ডসহ দুর্ঘটনা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, কর্মপরিবেশ নিশ্চিক করাসহ অন্য শর্তগুলো পরিপালন করতে অনেক সময় ও অর্থের প্রয়োজন।
তবে বিজিএমইএর সভাপতির সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত প্রকাশ করেন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি তপন চৌধুরী। তিনি বলেন, এখনকার কারখানার মালিকদের ধ্যানধারণা ৩০ বছরের আগের মতো নয়। কারখানার মালিকেরা শ্রমিকদের স্বার্থেও অনেক কাজ করেন।
নিট পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য মালিক, শ্রমিক, সরকার, বিদেশি ক্রেতা ও সংস্থা—সবাই মিলে চেষ্টা করছেন।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের মহাসচিব রায় রমেশ চন্দ্র বলেন, রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের টাকা স্বচ্ছতার সঙ্গে দিতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে আইএলওর নেতৃত্বে একটি বহুপক্ষীয় কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ক্ষতিপূরণ পাওয়া ক্ষতিগ্রস্তের অধিকার। এটা কোনো দাতব্য (চ্যারিটি) নয়। এ জন্য বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট তহবিল গঠন করতে হবে। এ ছাড়া শ্রমিকদের কর্মস্থলের (ওয়ার্কপ্লেস) বিপরীতে বিমা করার দাবি করেন তিনি।
শ্রমিক সংগঠন ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি ফর ওয়ার্কার্স এডুকেশনের চেয়ারপারসন জাফরুল হাসানের মতে, রানা প্লাজা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানে আরও স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত, রানা প্লাজা ধসের পর থেকেই বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশের গুণগত পরিবেশ উন্নয়নের বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। ওই ঘটনার ১০ দিনের মাথায়, ২০১৩ সালের ৪ মে আইএলওর মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ সরকার, মালিক ও শ্রমিক পক্ষ ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই করে। সংকট উত্তরণে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও আইএলওর পাশাপাশি বিশ্বের প্রখ্যাত ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতারা বাংলাদেশের প্রয়াসে যুক্ত হওয়ার অঙ্গীকার করে। ওই দুর্ঘটনার শিকার হওয়া শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের জন্য রানা প্লাজা ডোনারস ট্রাস্ট ফান্ড গঠিত হয়। আইএলওর পরিচালনায় ওই ট্রাস্ট ফান্ডে ৪০ মিলিয়ন বা

চার কোটি ডলার সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও গতকাল পর্যন্ত ওই তহবিলে জমা হয়েছে ১৬ মিলিয়ন ডলার। ক্ষতিপূরণ তহবিলে কাঙ্ক্ষিত অর্থ জোগাড় না হওয়ার কারণেই উন্নয়ন-সহযোগীরা হতাশার কথা বলতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি ক্রেতা ব্র্যান্ডগুলোর অঙ্গীকার পূরণের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা অব্যাহত রাখতে শ্রমমানের বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। রানা প্লাজার এক বছর পূর্তিতে ইইউর বাণিজ্য কমিশনার কারেল ডি গুখটের মুখপাত্র জন ক্ল্যান্সি গতকাল এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিয়োগান্ত ওই দুর্ঘটনার পর ইইউ, আইএলও এবং বাংলাদেশ সরকার সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট নামের একটি কর্মসূচি শুরু করে। পরে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্র। ব্যাপকভাবে শ্রমিক স্বার্থ সুরক্ষা বিশেষ করে সংগঠিত হওয়া ও যৌথ দর-কষাকষির অধিকারের পাশাপাশি পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং দায়িত্বশীল ব্যবসার বিকাশে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করা হয়েছে সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্টে।
বিগত মাসগুলোতে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেছি। তবে এখনো অনেক কিছু করার আছে। ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার বাজার-সুবিধা অব্যাহত রাখতে হলে শ্রমমানের ব্যাপক পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়। শ্রমমানের সংস্কার ও সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে তৈরি আছে ইইউ। সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্টের আওতায় সামগ্রিক অগ্রগতির পর্যালোচনা হবে এ বছরের জুলাইয়ে।