দুই হাজার একর জমি ১৫ বছর অনাবাদি

১৫ বছর আগেও সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার ‘ভাইমারা’ হাওরের উৎপাদিত ধানে গোলা ভরত হাওরপাড়ের চার শতাধিক কৃষক পরিবার। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে হাওরটির ফসল ১৯৯৫ সাল থেকে টানা কয়েক বছর পানিতে তলিয়ে ছিল। বাধ্য হয়ে ১৯৯৯ সাল থেকে হাওরটিতে চাষাবাদ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছেন কৃষকেরা। এতে অনাবাদি হয়ে পড়েছে হাওরটির দুই হাজার একর জমি। হাওর পারের কৃষকেরা জীবন বাঁচাতে হয়ে পড়েছেন জেলে।
এ সংকট নিরসনে কৃষকেরা হাওরটিতে একটি বেড়িবাঁধ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, কৃষি কার্যালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও উপজেলা প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই।
ভাইমারা হাওরটি দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। এ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে হাওরটি আগাম বন্যাকবলিত হয়। পানি ঠেকাতে দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের মানিকখিলা গ্রামের নিকটবর্তী কানমুইয়া হাওরের পশ্চিম পারের খলার টোব থেকে বিশারা গ্রামের কাছিমধরা পর্যন্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রয়োজন।
ইউপি চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ সরকার বলেন, হাওরটির এই তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মিত হলে হাওর পারের দুর্লভপুর, শরীফপুর, বিশারা ও নোয়াগাঁও গ্রামের ৪০০ কৃষক পরিবার তাদের পেশা ফিরে পাবে। পরিবারে সচ্ছলতা আসবে। এ ব্যাপারে কোনো খোঁজ রাখে না উপজেলা কৃষি কার্যালয়! যোগাযোগ করলে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলে ফেলেন, ‘ভাইমারা হাওরে ধান কাটা চলছে।’ কিন্তু ১৫ বছর ধরে হাওরটি অনাবাদি রয়েছে—উল্লেখ করলে বলেন, ‘তাই নাকি, খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ইউপি সদস্য মহিবুর রহমান বলেন, ‘স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হাওরে যান না, তাই ভাইমারা হাওরের খবর জানেন না।’ তিনি জানান, ভাইমারা হাওরের অধিকাংশ জমিই দুর্লভপুর গ্রামের কৃষকদের। সম্প্রতি দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নে গিয়ে ইউপি কার্যালয় থেকে চারদিকে হাওরের বুকজুড়ে সোনালি ধান দেখা যায়। কিন্তু কিছু দূর এগোতেই ভাইমারা হাওরে চাষাবাদের কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। হাওরটি ভরে আছে ঘাসে।
স্থানীয় বাসিন্দা সমাজকর্মী মানিক বলেন, ‘১০ বছর আগে লিখিতভাবে ভাইমারা হাওরে বেড়িবাঁধ দেওয়ার কথা জানিয়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছিলাম। দুর্গম ও অবহেলিত এ এলাকার সমস্যা দেখতে ও নিরসনে প্রশাসনের তৎপরতা নেই।’
দুর্লভপুর গ্রামের বাসিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবদুর রহমান জানান, ২০ বছর আগেও গ্রামের কৃষক পরিবারগুলোতে দোতলা টিনের ঘর ছিল, গোয়ালভরা গরু ছিল এবং বর্ষায় যাতায়াতে ছিল বাহারি নৌকা। কিন্তু ভাইমারা হাওরের জমি চাষ করতে না পেরে সবকিছু বিক্রি করে এই পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।
একই গ্রামের মো. আবদুস ছোবান (৬৫) বলেন, ‘হাওরটিতে আমার ৫০ কিয়ার (এক কিয়ার=৩০ শতক) জমি আছে। চাষাবাদ করতে না পেরে জমি থেকেও এখন আমি ভূমিহীন। ছিলাম কৃষক, জীবন বাঁচাতে এখন জেলে।’
‘ভাইমারা আওরের ধানদিয়া দুলুভপুর, শরীফপুর গেরামের গৃহস্থরা উগার (গোলা) ভরত। এখন এই দুই গেরামের গৃহস্থের বাড়িত ধান নাই, উগারও নাই।’ বলেন শরীফপুর গ্রামের গৃহবধূ তারুবালা (৬৮)।
সদ্য যোগদানকারী তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহফুজুল হক বলেন, ‘ভাইমারা হাওরের জমি চাষাবাদের আওতায় আনতে সরেজমিনে দেখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠাব।’
কৃষি অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের উপপরিচালক আবুল হাসেম বলেন, হাওরটির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।