সাজা কম খেটেই বেরিয়ে যান সাংসদ

সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারী
সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারী

দুই বছর ১০ মাস কম সাজা খেটেই কারাগার থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ফেনী-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারী। অস্ত্র আইনের একটি মামলায় তাঁর ১০ বছর সাজা হয়েছিল। কারাগার কর্তৃপক্ষ এটিকে জালিয়াতি বলে মন্তব্য করেছে।
একাধিক আইনজীবী ও কারাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, এই জালিয়াতির ঘটনা সত্য হলে নিজাম হাজারীকে আবার কারাগারে ফিরে যেতে হবে। জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে নতুন করে মামলাও হতে পারে।
আদালত সূত্র জানায়, ২০০০ সালের ১৬ আগস্ট অস্ত্র আইনের ১৯(ক) ধারায় ১০ বছর এবং ১৯(চ) ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ড হয় নিজাম হাজারীর। চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং থানায় হওয়া মামলায় চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাঁকে এই সাজা দিয়েছিলেন। উভয় দণ্ড একসঙ্গে চলবে বলে রায়ে বলা হয়। অর্থাৎ ১০ বছর সাজা ভোগ করবেন নিজাম হাজারী।
এই আদেশের বিরুদ্ধে নিজাম হাজারী হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। উচ্চ আদালত তাঁর সাজা বহাল রাখেন। সর্বশেষ তিনি রিভিউ আবেদন করলে আদালত তা খারিজ করে দেন।
চট্টগ্রাম কারাগার সূত্র জানায়, নিজাম হাজারী ১৯৯২ সালের ২২ মার্চ হাজতে যান। হাজতে যাওয়ার দুই দিন পর (২৪ মার্চ ১৯৯২) তাঁকে আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়া হয়। ওই বছরের ২৮ জুলাই তিনি জামিন পান। কিন্তু তাঁর আটকাদেশ বাতিল হয় ওই বছরের ১৫ আগস্ট এবং ওই দিনই তিনি কারাগার থেকে ছাড়া পান। এই হিসাবে, নিজাম হাজারী হাজতে ছিলেন ১৯৯২ সালের ২২ মার্চ থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মোট চার মাস ২৪ দিন।
কোনো মামলায় সাজার আদেশ হওয়ার আগে কারাগারে থাকা সময়কে হাজতবাস এবং সাজা ঘোষণার পরের সময়কে কয়েদ খাটা বলা হয়।
নথিপত্রে দেখা যায়, পলাতক থাকা অবস্থায়ই ২০০০ সালের ১৬ আগস্ট ওই মামলায় নিজাম হাজারীকে সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল। ২০০০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন এবং তাঁকে ওই দিনই কারাগারে পাঠানো হয়। তাঁর কয়েদি নম্বর ছিল ৪১১৪/এ। ২০০৫ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। অর্থাৎ, কয়েদি হিসেবে তিনি কারাভোগ করেন পাঁচ বছর দুই মাস ১৭ দিন।
এই হিসাবে হাজতবাস ও কয়েদ—দুয়ে মিলে নিজাম হাজারী সাজা ভোগ করেছেন পাঁচ বছর সাত মাস ২১ দিন। তাঁকে সাজা রেয়াত (মাফ) দেওয়া হয়েছে এক বছর ছয় মাস ১৭ দিন। কারাগারে সর্বনিম্ন নয় মাসে বছর ধরা হয়। তবে কত মাসে বছর হবে, তা নির্ধারিত হয় কয়েদির আচরণের ওপর ভিত্তি করে।
কারাগারে ঢোকা ও মুক্তি পাওয়ার সময় ধরে নিজাম হাজারী চার মাস ২৪ দিন হাজতবাস করেছেন। কিন্তু তাঁর কয়েদি রেজিস্টারের তথ্য হলো, তিনি তিন বছর দুই মাস ২৫ দিন হাজত খেটেছেন। সূত্র জানায়, নিজাম হাজারীর হাজতি রেজিস্টারের তথ্য কয়েদি রেজিস্টারে স্থানান্তরের সময় তাঁর হাজতবাসের সময় বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কারাগারের জ্যেষ্ঠ সুপার মো. ছগির মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনে হচ্ছে এটা জালিয়াতি। এই হিসাবটা কীভাবে করা হয়েছে, সেটা আমারও বোধগম্য নয়। তৎকালীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কেবল এর জবাব দিতে পারবেন। কারাগারের হিসাব বলছে, নিজাম হাজারী দুই বছর ১০ মাস এক দিন কম কারাভোগ করে বেরিয়ে গেছেন।’
আদালত সূত্র জানায়, মামলাটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন অবস্থায় আসামি নিজাম হাজারী নানাভাবে কালক্ষেপণের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। বিষয়টি আদালতের নজরে আসে। হাইকোর্টের আপিল আদেশেও বিচারপতি এ কে বদরুল হক ও বিচারপতি এ এফ এম মেছবাউদ্দিন বিষয়টি তুলে ধরেন। ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল এ দুই বিচারপতির বেঞ্চে নিজাম হাজারীর আপিল শুনানি শুরু হয় (ফৌজদারি আপিল ২৩৬৯/২০০০)। একই বছরের ২ মে তাঁরা ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাজা বহাল রেখে রায় দেন।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নিজাম হাজারী সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন (নম্বর ১০৭/২০০১)। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি

মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর নেতৃত্বে বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ও বিচারপতি এফ এম হাসান আপিল নাকচ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। পরে নিজাম হাজারী সুপ্রিম কোর্টে রায় বিবেচনার জন্য রিভিউ আবেদন করেন (নম্বর ১৮/২০০২)। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছের হোসেনের নেতৃত্বে বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ও বিচারপতি আমীরুল কবির চৌধুরী আবেদন খারিজ করে দেন। ফলে নিজাম হাজারীর ১০ বছরের দণ্ড বহাল থেকে যায়।
হলফনামায় ভিন্ন তথ্য: নিজাম হাজারী ২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারি ফেনী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি যে হলফনামা দাখিল করেন, তাতে তিনি এই মামলায় সাজার তথ্য গোপন করেন। তাঁর হলফনামায় মামলা-মোকদ্দমার ঘরে লেখা হয় ‘খালাসপ্রাপ্ত’। ২০০৬ সালের ১৯ আগস্ট তিনি খালাস পান বলে এতে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু তিনি সাজা খেটে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন ২০০৫ সালের ১ ডিসেম্বর।
পৌর মেয়র পদ থেকে ইস্তফা না দিয়ে গত ৫ জানুয়ারি নিজাম হাজারী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন। এবার হলফনামায় তিনি মামলা-মোকদ্দমার ঘরে লেখেন ‘মামলা নিষ্পত্তি ও মুক্তি’।
সাংসদ নিজাম হাজারীর বক্তব্য: চার মাস ২৪ দিনের জায়গায় তিন বছর দুই মাস ২৫ দিন হাজতবাসের তথ্য দেখানোর বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ নিজাম হাজারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো এখন কিছু বলতে পারব না। এসব তো নথিতে আছে।’
এটা কি হিসাবের ভুল, নাকি জালিয়াতি—এ প্রশ্ন করা হলে নিজাম হাজারী বলেন, ‘জালিয়াতি কেন হবে?’
তাহলে কী ভুল? এবার সাংসদ নিজাম বলেন, ‘নথি না দেখে এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না।’
ফেনীর পৌর মেয়র পদে মনোনয়ন দাখিলের সময় হলফনামায় আপনি তথ্য দিয়েছেন, ২০০৬ সালের ১৯ আগস্ট মুক্তি পান। কিন্তু কারাগারের নথিতে আছে, আপনি ২০০৫ সালের ১ ডিসেম্বর সাজা খেটে মুক্তি পেয়েছেন। তাহলে কোন তথ্যটি সত্য? জবাবে সাংসদ নিজাম হাজারী বলেন, ‘কারাগারের নথির তথ্য সত্য।’
হলফনামায় আপনি তাহলে ভুল তথ্য দিয়েছেন? জবাবে নিশ্চুপ থাকেন নিজাম। প্রসঙ্গত, হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে প্রার্থিতা বাতিলের বিধান আছে।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এই সাংসদের নির্বাচন করার যোগ্যতা ছিল কি না, নির্বাচন কমিশনকে এখন তা খতিয়ে দেখতে হবে। তাঁর জালিয়াতির বিষয়টিও শিগগিরই তদন্তের আওতায় আনা উচিত।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ক্ষমতাসীন দলের জন্য এটি আরেকটি বিব্রতকর বিষয়। এর দায় দল এড়াতে পারে না। কারণ, এর মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করার প্রক্রিয়া প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তা ছাড়া এ ঘটনার মধ্য দিয়ে নিয়মনীতি মানার ক্ষেত্রে কারা প্রশাসনের অবহেলা ও দুর্বলতা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে।