দলীয় হানাহানিতে দিশেহারা আ.লীগ

নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে জড়িয়ে দিশেহারা আওয়ামী লীগ। শুধু ছাত্রলীগ-যুবলীগ নয়, মন্ত্রী-সাংসদ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে অন্তর্দ্বন্দ্ব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হানাহানির মূলে রয়েছে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ এবং দখলবাজি প্রতিষ্ঠা।
নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, লক্ষ্মীপুরে একের পর এক হানাহানি এখন সারা দেশে মূল আলোচনার বিষয়। খুলনা, কুমিল্লাসহ অন্য অনেক জেলাতেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে৷ অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে সন্ত্রাসের গডফাদারদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে যাওয়ার সাহসই পাচ্ছেন না কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতা৷
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ মে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে সাংগঠনিক এক বৈঠকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুর বলেছেন, লক্ষ্মীপুরে হানাহানি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে তিনি সেখানে গিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করার পরিবেশই পাচ্ছেন না৷ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের নিয়ে এ বৈঠকটি করেছিলেন।
বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ হয়েছে ২৮ বার৷ আর বিভিন্ন জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, একই সময়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংঘর্ষে খুন হয়েছে অন্তত ১৬ জন৷
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান প্রথম আলোকে বলেন, অন্তর্কলহ সব দলেই আছে, সরকারে গেলে তা বৃদ্ধি পায়। এই কলহ সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষে৵ হলে তা রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রূপ নেয়। এখন দেশে সেটাই চলছে। যত দিন যাচ্ছে, এটা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে রাজনীতি নেই। এ জন্যই কেন্দ্রের মাথাব্যথা কম। যেমন আছে, তেমনই চলছে।
নারায়ণগঞ্জ, ফেনী ও লক্ষ্মীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন গডফাদার হিসেবে পরিচিত নেতারা। সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাও এঁদের ঘাঁটাতে চান না। আওয়ামী লীগের তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন স্থানে হানাহানির মূল কারণ অবৈধ অর্থ ও পেশিশক্তি। পর পর দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়৷ অবৈধ অর্থ আয়ের উৎসগুলোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দলেরই আরেকটি অংশ। তাই পেশিশক্তির রক্তাক্ত প্রয়োগ হচ্ছে নিজ দলেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর একশ্রেণির নেতা-কর্মী আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন৷
ওই তিন নেতা বলেন, নিজেদের মধ্যে হানাহানি বন্ধের দুটি পথ আছে। সন্ত্রাসে জড়িত নেতাদের দলগতভাবে কোণঠাসা করা এবং আইনের আওতায় আনা। কিন্তু এসব কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার মানসিকতা বর্তমান নেতৃত্বের নেই।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ৫ জানুয়ারির পর ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অনেকেই মনে করছেন যুদ্ধজয় হয়ে গেছে। এখন যে যা পারে নিতে ব্যস্ত। যেহেতু বিরোধী পক্ষ নেই, তাই এখন নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ। তাঁরা জানেন, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছু করবে না। ফলে কারও মনে ভয়-ডর নেই।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সমালোচনা আছে, দলের কমিটি হয় না বলে নতুন নেতৃত্ব আসতে পারে না। কিন্তু নেতৃত্ব পরিবর্তনে সমস্যার সমাধান হবে না৷ কারণ, এখন যেসব হানাহানি হচ্ছে, তা পদ-পদবির জন্য নয়। মূল কারণ, আধিপত্য বিস্তার, দরপত্র ও চাঁদার নিয়ন্ত্রণ এবং অবৈধ দখলবাজি।
এই নেতা আরও বলেন, এরশাদের আমল বাদ দিলে পর পর দুবার ক্ষমতার স্বাদ নেওয়ার অভিজ্ঞতা এর আগে কোনো দলের ছিল না৷ ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হলে সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠকে এক প্রবীণ সাংসদ বলেছিলেন, ‘আমরা ক্ষমতায় যেতে না পেরে ভালোই হয়েছে। কারণ, পুনরায় ক্ষমতায় গেলে আমার মতো বুড়োকেও আয়ত্তে রাখতে পারতেন না।’
এখন সেই অবস্থায়ই চলছে। আওয়ামী লীগের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের সরকারের আমলে নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমান, ফেনীতে জয়নাল হাজারী, লক্ষ্মীপুরে আবু তাহের আর বরিশালে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও ঢাকায় মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর কর্মকাণ্ডে সরকার ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়৷ ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের জন্য এঁদের কর্মকাণ্ডকেও দায়ী করা হয়৷ তাঁরাই এখন আবার দলকে সমালোচনার মুখে ফেলছেন।
এদিকে প্রথম আলোর ভোলা প্রতিিনধি জানান, গতকাল ভোলার লালমোহনে একটি সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগাযোগমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেনী—সারা দেশের আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে। দল থেকে ‘আগাছা-পরগাছা-হাইব্রিড-ফরমালিন দেওয়া’ নেতাদের সমূলে উৎপাটন করা হবে। দলে বসে মাস্তানি-খুনোখুনি করা চলবে না। নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্তে যে দোষী হবে, তাকেই শাস্তি পেতে হবে৷
ওবায়দুল কাদের কঠোর অবস্থানের কথা জানালেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন৷ কারণ, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল রক্তক্ষয়ী রূপ নিলেও দায়ী কোনো বড় নেতার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত আইনগত শক্ত ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি৷
গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, একশ্রেণির লোক আছে, যারা সব সময় সরকারি দলে আশ্রয় নিয়ে অপরাধ করে থাকে৷ উদাহরণ হিসেবে তিনি নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেনের নাম বলেন৷ এই নূর হোসেন

একসময় জাতীয় পার্টি ও বিএনপি করতেন৷ পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন৷ তবে এ ধরনের লোককে কেন দলে নিয়ে পদ দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তা বলেননি৷
পেশিশক্তিতে নিয়ন্ত্রণ: দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক নেতাই মনে করছেন, নারায়ণগঞ্জ, ফেনী ও লক্ষ্মীপুরে সবকিছুই এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে পেশিশক্তির জোরে। লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। দীর্ঘদিন পলাতক ও কারাগারে থাকার পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি আবার দলে ফিরে আসেন৷ তিনি পৌর মেয়র হন। এরপর দলে পদ না পেলেও সেখানকার রাজনীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ তাঁর৷ তাঁর ছেলে এ কে এম সালাউদ্দিন দলের সমর্থন নিয়ে এবার উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ায় সেখানে তাহের পরিবারের নিয়ন্ত্রণ আরও পাকাপোক্ত হয়েছে।
লক্ষ্মীপুরে গত সাড়ে পাঁচ মাসে ৩৫ জন খুন হয়েছেন। ১৩ জনই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয়েছেন অন্তত পাঁচজন৷ লক্ষ্মীপুরে ২০-২২টি সন্ত্রাসী দল-উপদল রয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে৷ চার দিন ধরে লক্ষ্মীপুরে যৌথ অভিযান চলছে৷ কিন্তু দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি৷
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে শামীম ওসমান পালিয়ে গেলে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর এস এম আকরামের নেতৃত্বে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আকরাম পদত্যাগ করেন। যুগ্ম আহ্বায়ক মারা গেছেন। এখন কোনো পদে না থেকেও শামীম ওসমানই নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের হর্তাকর্তা। সাম্প্রতিক সাত খুনসহ হানাহানির ফলে এই জেলাটিকে আওয়ামী লীগের নেতারাই ‘হত্যার জনপদ’ বলছেন।
ফেনীতে জয়নাল হাজারী যুগের অবসানের পর সেখানকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীর হাতে। তিনি এখন সদর আসনের সাংসদ। সেখানে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে সেখানে সম্প্রতি ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা একরামুল হককে গুলি করে ও পুড়িয়ে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে৷
প্রায় একই অবস্থা খুলনাতেও। মহানগরের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক ও সাধারণ সম্পাদক সাংসদ মিজানুর রহমানের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগে গত দুই মাসে অন্তত ছয়বার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে৷
কুমিল্লা সদর দক্ষিণে মুজিবুল হক, আফজল খান ও আ ক ম বাহাউদ্দিনের মধ্যে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব চলছে৷ গত বৃহস্পতিবার সেখানে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে সাংসদ বাহাউদ্দিনের ভাতিজা নিহত হয়েছেন৷
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, দলকে সংগঠিত করা ছাড়া এসব সমস্যা সমাধান করা যাবে না। দল সংগঠিত করতে হলে তা গঠনতন্ত্র মোতাবেক চালাতে হবে। অনুগ্রহতন্ত্র দিয়ে চললে হবে না। গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে, সরকারের কর্মসূচির সঙ্গে দলকে সম্পৃক্ত করতে হবে৷
অবশ্য ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের মতে, ক্ষমতাসীনেরা বরাবরই এ কাজ করে। তবে নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও ফেনীর সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত খুবই ভয়ানক। এর সবগুলোই ঘটেছে দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে রাজনীতির মাঠ দখল করে সম্পদ গড়ে তোলার ইচ্ছা থেকে। এটা সুস্থধারার রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে সম্পদ অর্জনের সংঘাতপূর্ণ পথকেই দুর্বৃত্তরা সঠিক মনে করছে। সরকার ও রাজনীতিতে জবাবদিহির কাঠামো অনুপস্থিত বলে এটা বন্ধ হচ্ছে না। এসব বন্ধ করতে হলে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সুষ্ঠু বিচার করতে হবে। পাশাপাশি সরকার ও রাজনীতি দুই জায়গাতেই সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।