চিকিৎসক, প্রকৌশলী হতে চায় ওরা

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার নাইস আক্তারের বাবা নেই। নাটোরের লালপুরের সাদিয়া ইসলামের বাবা ভ্যানচালক। এক পোশাকে পরীক্ষা দিয়েছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের বীথি দাস। কষ্ট করে পড়েছে নীলফামারীর ডোমারের ফাতেমা বেগম। ছোটবেলা থেকেই অভাবের সঙ্গে লড়াই করে লেখাপড়া করেছে ওরা। এসএসসি পরীক্ষায় পেয়েছে জিপিএ-৫। ওরা কেউ চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী হয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখে। আজ শুনব এই চার ছাত্রীর গল্প:

নাইস আক্তার
নাইস আক্তার

বাবাকে হারিয়েও দমেনি নাইস: মাটির ঘর। তাতে একটাই জানালা। বাবা মাহতাব উদ্দিন চার বছর আগে মারা গেছেন। মা মাবিয়া বেওয়া অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। তিনি যা আয় করেন, তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই পড়াশোনার খরচ মেটানোর জন্য মাঝেমধ্যে গৃহশিক্ষকতা করত নাইস আক্তার। বিদ্যুৎ না থাকায় কুপিবাতির আলোয় পড়েছে সে। কষ্ট করে পড়াশোনা করে সে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বনকিশোর উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। কলেজে ভর্তি হয়ে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করার জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন। কিন্তু তার মায়ের ওই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তাই ভালো ফল করলেও নাইস এখন ভীষণ হতাশ। বনকিশোর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল হক বলেন, নাইস একজন অসম্ভব মেধাবী মেয়ে। অষ্টম শ্রেণিতেও সে বৃত্তি পেয়েছিল। নাইস জানায়, সে চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে চায়।

সাদিয়া ইসলাম
সাদিয়া ইসলাম

গৃহশিক্ষকতা করত সাদিয়া: ফলাফল প্রকাশের দিন একটি বাড়িতে প্রাইভেট পড়াচ্ছিল সাদিয়া ইসলাম। বৃদ্ধ দাদি যখন তাকে এসে জানালেন ‘তুই জিপিএ-৫ পাইছিস,’ তখন আনন্দে তার চোখে পানি আসে। সাদিয়া লালপুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিল। অনেক ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে সে এ সাফল্য পেয়েছে। সে গরিব ঘরের মেয়ে। তার বাবা শফিকুল ইসলাম কখনো রাজমিিস্ত্র, আবার কখনো মাছ ধরার জাল টানার কাজ করেন। তিনি যা আয় করেন, তা দিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয়। এ অবস্থায় মেয়েকে কলেজে ভর্তি করার সামর্থ্য নেই তাঁর। সাদিয়া জানায়, সে বড় হয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য কাজ করবে। এ ছাড়া সে প্রকৌশলী হয়ে দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে চায়। ওদের বাড়ি লালপুর উপজেলার উত্তর লালপুর গ্রামে।

বীথি দাস
বীথি দাস

এক কাপড়ে পরীক্ষা দিয়েছে বীথি: বীথি দাসের বাবা নারায়ণ চন্দ্র দাস ভ্যানচালক। তিনি দিনে ২০০ টাকার বেশি আয় করতে পারেন না। বীথিরা দুই ও ভাই বোন। বড় ভাই কার্তিক চন্দ্র ঢাকার তিতুমীর কলেজে লেখাপড়া করেন। তিনি গৃহশিক্ষকতা করে লেখাপড়া করেন এবং বোনকে লেখাপড়ার খরচ দেন। বাবার আয়রোজগার কম বলে ভালো খাবার খেতে পারে না বীথি। পূজার সময় কিনে দেওয়া কম দামের একটি জামা পরে সে ১১টি বিষয়ের পরীক্ষা দিয়েছে। সে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের সলিমুননেছা বালিকা বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। স্থানীয় মাহাতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা আছে তার। সে পড়াশোনা করে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ওদের বাড়ি কালীগঞ্জ উপজেলার ফয়লা গ্রামে।

ফাতেমা বেগম
ফাতেমা বেগম

মা-বাবার কষ্ট দূর করতে চায় ফাতেমা: ফাতেমা বেগমের বাবা জাহেরুল ইসলাম ও মা রেখা বানু দিনমজুর। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে ফাতেমা বড়। গরিব ঘরে জন্ম হলেও ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তার। দুবেলা ঠিকমতো খেতে পারেনি। পরতে পারেনি ভালো পোশাক। হাজারো সমস্যার মধ্যে পড়াশোনা করে সে এবার নীলফামারীর ডোমার উপজেলার খাটুরিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ওদের বাড়ি ডোমারের খাটুরিয়া জুম্মাপাড়া গ্রামে। ফাতেমা পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। বড় সন্তান হিসেবে পড়াশোনা করে প্রকৌশলী হয়ে বাবা-মায়ের কষ্ট দূর করার স্বপ্ন দেখে সে। তার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, মেয়েটি খুব মেধাবী। একটু সহায়তা পেলে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী; মুক্তার হোসেন, নাটোর; আজাদ রহমান, ঝিনাইদহ ও মীর মাহমুদুল হাসান, নীলফামারী}