আটক

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল প্রিয়ন্তী। তখন প্রায় সন্ধ্যা। তার দুটি চোখ বড় রাস্তার দিকে। ওই পথেই প্রতিদিন যাওয়া-আসা করে শোভন। আজ তার দেখা নেই। নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাচ্ছে আর প্রিয়ন্তীর ছটফটানি বেড়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ বেজে ওঠে কলবেল। প্রিয়ন্তী দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। দরজা খুলেই তার চোখ ছানাবড়া। শোভন দাঁড়িয়ে আছে।
‘ভেতরে আসতে পারি?’
প্রিয়ন্তী কোনো কথা বলে না। শোভন নিজেই পাশ কাটিয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসে। বসতে বসতে বলে, ‘দূর থেকে দেখতে আপনার কষ্ট হচ্ছে, তাই কাছে চলে আসলাম। আমি কারও কষ্ট সহ্য করতে পারি না।’
এমন কথা আশা করেনি প্রিয়ন্তী। হঠাৎ সে রেগে গিয়ে বলে, ‘আমি আপনাকে দেখি কে বলেছে?’
‘আমাদের মাঝে অন্য কাউকে ডেকে আনবেন না। আমি নিজেই তো সেটা দেখি। আর তা ছাড়া...।’
‘তা ছাড়া কী?’
‘তা ছাড়া আমিও আপনাকে দেখি। দূরের রাস্তা থেকে আপনাকে কতটুকুই বা দেখা যায় বলুন। আজ সাহস করেই ফেললাম।’
কথা শুনে প্রিয়ন্তীর চোখে-মুখে একটি হাসির ঝিলিক খেলে যায়।
ভেতরের ঘর থেকে প্রিয়ন্তীর মায়ের গলা—
‘কে রে প্রিয়...?’
‘কেউ না মা। একটা বিড়াল...।’
‘কী বলিস তুই! আমি একটা মানুষের গলা পাচ্ছি যে।’
‘আমি বিড়াল?’
‘বিড়ালই তো। ভয়ে ভয়ে ছিলেন। তা না হলে কি এত দিন পরে আসে কেউ?’
‘ও মা, এমন অভয় পেলে তো আরও আগেই চলে আসতাম।’
‘আপনি বসুন। আমি মাকে নাশতা খাইয়ে আসি। মা অসুস্থ, বিছানা থেকে উঠতে পারেন না...।’
প্রিয়ন্তী মায়ের ঘরে ঢুকে যায়।
বেশ অস্বস্তি হতে থাকে শোভনের। দেয়ালের দিকে তাকায়। বুকশেলফের বই দেখে। দৈনিক পত্রিকা হাতে নেয়। সময় কাটায়।
কিছুক্ষণ পরেই প্রিয়ন্তী বেশ সাজগোজ করে ড্রয়িংরুমে আসে।
‘চলুন, আপনার সঙ্গে আজ ঘুরতে যাব।’
শোভনের হাত ধরে। শোভন বিস্মিত। এতটা আশা করেনি। দু-একবার হাত ছাড়ানোর চেষ্টাও করে সে। পরে আর বাধা দেয় না। ঘরের বাইরে থেকে লাঠি ভর দিয়ে প্রিয়ন্তীর মা এসে দাঁড়ান। শোভন প্রিয়ন্তীর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে যায় সেদিকে। তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।
‘যাও, আমার প্রিয়ন্তীকে নিয়ে একটু ঘুরে আসো। বেশি রাত কোরো না বাবা।’
কিছু বলে না শোভন। সে নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখে ব্যাপারগুলো সত্যি হচ্ছে কি না।
রিকশায় উঠেছে ওরা। প্রিয়ন্তী শোভনের একটি হাত জড়িয়ে ধরেছে। রিকশা যাচ্ছে পুব দিকের রাস্তায়। হাওয়ায় উড়ছে প্রিয়ন্তীর চুল। সে চুলের স্পর্শ লাগছে শোভনের চোখে-মুখে।
কী যে ভালো লাগছে আমার...। এমন অনুভূতি শোভনের। একটি জায়গায় রিকশা থামে। প্রিয়ন্তী লাফিয়ে ওঠে।
‘চলো, ফুচকা খাব।’
দুজনে বসে ফুচকা খায়।
সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হয়।
‘চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই।’
‘পৌঁছে দিই মানে? আজ তোমাকে ছাড়ছিনে। তোমার আর ফাঁকি দেওয়া চলবে না। ’
কথাটা কেমন অস্বাভাবিক মনে হয় শোভনের। তাদের রিকশা চলে এসেছে প্রিয়ন্তীদের বাসার সামনে। শোভনের হাত খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে সে।
‘চলো।’
‘হাত ছাড়ো।’
‘আশ্চর্য। তোমার হাত ছাড়ব কেন! এত দিন পরে পেয়েছি।’
রিকশা ভাড়া দিয়ে ওরা উঠে যায় ওপরে। প্রিয়ন্তীদের তিনতলা বাসায়।
প্রিয়ন্তির মা ড্রয়িংরুমেই সোফার ওপর গা এলিয়ে দিয়েছেন। ওদের দেখে ওঠার চেষ্টা করেন। প্রিয়ন্তী বলে, ‘আম্মু, ওঠার দরকার নেই। তুমি শুয়ে থাকো। আমি চেঞ্জ করে আসি। দেখো নন্দন যেন চলে না যায়।’ এ কথা বলে সে ভেতরের ঘরে চলে যায়।
শোভনের মুখে কোনো কথা নেই। সে বোবা হয়ে বসে আছে।
প্রিয়ন্তীর মা বলেন, ‘ও তোমাকে নন্দন ভেবেছে। ওর প্রেমিক। সে আজ পাঁচ বছর ধরে নিরুদ্দেশ। তারপর থেকেই ওর মাথাটা খারাপ। আবার কখনো বা ভালোও থাকে। ও চেঞ্জ করতে গেছে। এই ফাঁকে তুমি চলে যাও, বাবা। তোমাকে অনুরোধ করছি।’
কথা শুনে শোভন লাফিয়ে উঠে দরজার দিকে যায়। দরজা খোলে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ভেতরের ঘর থেকে দৌড়ে ছুটে আসে প্রিয়ন্তী।
‘অ্যাই, কোথায় যাচ্ছো? তোমাকে আটক করে রাখব।’
প্রিয়ন্তী শোভনকে জড়িয়ে ধরে।
‘চলো, ঘরে চলো।’