গণমাধ্যম, পুলিশ-র্যাব শামীমের কাছে সব তুচ্ছ

কার্টুন: শিশির
কার্টুন: শিশির

গণমাধ্যম, পুলিশ-র‌্যাব, নিজ দল আওয়ামী লীগ—তাঁর কাছে সবই যেন তুচ্ছ৷ সাংবাদিকেরা তাঁর কাছে সারমেয়৷ র‌্যাব-পুলিশকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারেন তিনি৷ নিজ দল আওয়ামী লীগের ওপরও তিনি ক্ষুব্ধ৷ কারণ, দলের অনেক নেতা তাঁকে পছন্দ করেন না। এর মধ্যেই ভাই সেলিম ওসমানকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জকে বদলে দিতে চান তিনি৷
তিনি সরকারি দলের আলোচিত সাংসদ শামীম ওসমান৷ গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের দোতলার একটি কক্ষে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর খোলামেলা আলাপচারিতার সারমর্ম করলে এই চিত্রই ফুটে ওঠে৷
বৃহস্পতিবার দিনটি ছিল নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে উপনির্বাচনের দিন৷ বিকেলে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে বসে নির্বাচনের খোঁজখবর রাখছিলেন শামীম ওসমান৷ নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার মো. বশিরউদ্দীনকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগের ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য নিতে সাংবাদিকেরা সেখানে যান৷ এঁদের মধ্যে ছিলেন দুটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান, প্রথম আলোর দুই সাংবাদিক৷ তিনি সবাইকে কক্ষে নিয়ে বসান৷ তবে শুরুতে পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি তিনি৷ বললেন, ‘তোমাদের সঙ্গে এমনি কথা বলি৷’ সাংবাদিকেরাও একে একে নানা প্রসঙ্গ তুললেন৷ নিজের আত্মবিশ্বাস, তাচ্ছিল্য, ক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়ে সেসব বিষয়ে কথা বলেন তিনি৷ প্রায় শেষ পর্যায়ে একজন সাংবাদিক এই আলাপচারিতায় উঠে আসা কিছু বিষয় এবং এ-সংশ্লিষ্ট অভিব্যক্তি প্রকাশের বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি ঘাড় নেড়ে সায় দেন৷
আলাপচারিতায় শামীম ওসমান গণমাধ্যম নিয়ে তাঁর মনোভাব অকপটে প্রকাশ করেন৷ তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা হচ্ছে কুকুর। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন পাড়ার অনেকে পয়সা হলে বাড়িতে কুকুর পুষত। ওদের বাড়ির সামনে গেলে কুকুরগুলো মুখ ভেংচাত। এর পর যাদের আরও পয়সা হলো, তারা মিডিয়া পোষা শুরু করল। এগুলো হলো অ্যালসেশিয়ান কুকুর। প্রশিক্ষিত। লাত্থি দিলেও এগুলো কামড়াতে আসে।’
শামীম ওসমান বলে চলেন, ‘যেমন ধরেন, বসুন্ধরার শাহ আলম। ওর আছে চারটা। কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, একটি অনলাইন পত্রিকা আর আরেকটি সান না কী যেন নামের ইংরেজি পত্রিকা। বাবুলের একটা পত্রিকা ছিল, আরেকটা টেলিভিশন নিছে। আজাদ সাহেব, ওনার আগে পত্রিকা ছিল একটা, তাঁর আরেকটা লাগবে। নতুন করে একটি টিভি চ্যানেল নিছে। পত্রিকা আছে একটাই, সেইটা হইলো ইত্তেফাক৷’
দম নিয়ে আবার শুরু করলেন শামীম ওসমান, ‘সালমান—ও তো একটা চোর। বড় চোর। ২৩ হাজার কোটি টাকা ও চুরি করছে। তারও পত্রিকা ছিল, এখন একটা টিভি চ্যানেল নিছে। আমি তো তারে দেখা হইলে বলি—চোর, চোর, চোর।’
প্রসঙ্গত, নুরুল ইসলাম বাবুল যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান৷ এই গ্রুপের মিিডয়া হচ্ছে দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টিভি৷ এ কে আজাদ হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান৷ দৈনিক সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোর এই গ্রুপের মিডিয়া৷ সালমান এফ রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান৷ এই গ্রুপের পত্রিকা ইংরেজি দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট ও ইনডিপেনডেন্ট টিভি৷
শামীম ওসমান বললেন, ‘কালকে যদি তোমাদের মালিক বলে, শামীম ওসমানের পক্ষে লিখো। তোমরা তাই করবা।’ এ সময় একজন সাংবাদিক বলেন, ‘মালিক যা বলবে আমরা তা-ই করব, তা সব সময় ঠিক না। আমরা চাকরি ছেড়েও দিতে পারি।’ আরেকজন সাংবাদিক বললেন, ‘কিছু কুকুর যেমন লেজ নাড়ায়, আবার কেউ কেউ ডাকাত আসলে চিৎকার করে৷ অনেক সময় তারা গ্রামও পাহারা দেয়।’
জবাবে শামীম ওসমান বলেন, ‘তোমরা যাইবাটা কই। হ্যাঁ, তোমরা চাকরি ছাড়তে পারো। কিন্তু সব মালিক যদি একই কথা বলে। কই যাইবা।’ তিনি বললেন, ‘এরা সবাই আমার বিরুদ্ধে লেখে। আমি কিচ্ছু বলি না। লেখুক। ওরা (মিডিয়ার মালিকেরা) কোত্থেকে উঠে আসছে, তা তো আমি জানি। ওরা অনেক ছোট জায়গা থেকে আজকে বড় জায়গায় আসছে। ওদের সবার সঙ্গে আমার ভালো খাতির আছে।’
ঘড়ির কাঁটার সময় তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। কথা শুরু হয়েছিল নির্বাচন কেমন হলো, ফলাফল কী আশা করছেন—এসব নিয়ে। জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ানো বড় ভাই সেলিম ওসমানের নিশ্চিত বিজয় হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন শামীম ওসমান।
আলাপের একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোনে হুমকি দেওয়ার প্রসঙ্গটি আবার উঠে আসে৷ এবার শামীম ওসমান বলেন, ‘আমার নাম করে তো অনেকেই

অনেককে ফোন করে। ও বাচ্চা ছেলে৷ তার পেটে আমি লাত্থি মারতে চাই না। আমি যদি বলি, ও তিন লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছে, তা কি ঠিক হবে? ছেলেটা কয়দিন আগে বিয়ে করেছে, একটা সন্তান আছে (আসলে এখনো সন্তান হয়নি)।’
নিজের দল আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতেও ছাড়লেন না শামীম ওসমান। বললেন, ‘আমার দলের অনেক নেতাই আমাকে দেখতে পারে না। আমার বিরুদ্ধে বলে। সেই জন্য আমি বলি, আমি সরকারি দলে থেকেও বিরোধী দলের লোক।’
একজন সাংবাদিক বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তো আপনার পক্ষে আছেন। সংসদে আপনার পরিবারের পক্ষে থাকার কথা বলেছেন।’ শামীম ওসমান বলেন, ‘আমার একমাত্র সম্বল আমার আপা (শেখ হাসিনা)। তিনি আমাকে স্নেহ করেন।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে শামীম ওসমান বলেন, ‘আমি যদি বলি, এক ডাকে লাখ লাখ মানুষ হাজির হবে। ১১০০ র্যাব আর ৪০০ পুলিশ নিমেষে উড়ে যাবে। এসব র্যাব-পুলিশ আমার কাছে কিছু না।’
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার প্রসঙ্গ এলে শামীম ওসমান বলেন, ‘আমিই প্রথম বলেছি, ওই খুনের ঘটনায় র্যাব জড়িত। এ কথা বলার পর র্যাব আমারে মারতে স্নাইপার (গুপ্তঘাতক) এনেছিল। আমি শুরুতেই বলেছিলাম, ওই খুনে র্যাবের তিনজন জড়িত। পরে তাদের জবানবন্দিতেও তা প্রমাণিত হয়েছে।’
নূর হোসেনের প্রসঙ্গ টেনে শামীম ওসমান বলেন, ‘আমি যদি তাকে শেল্টারই (আশ্রয়) দিতাম, তাহলে সে আমাকে বাপ ডাকত না। সাহায্য চাইত না।’
খুন হওয়া কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের বিষয়ে শামীম ওসমান বললেন, ‘র‌্যাবের ওরা আইসা নজরুলরে বলল, প্রতিদিন তুমি আমাদের দুই লাখ করে টাকা দিবা। বিনিময়ে এলাকায় মাদকের ব্যবসা করবা। নজরুল শোনে নাই। এসব বুঝতে পাইরা আমি নজরুলরে বলছিলাম, তুমি মারা পড়বা। বাঁচবা না।’
এই কথোপকথনের মধ্যে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে তাঁর নেতা-কর্মীরা ওই কক্ষে আসতে শুরু করেন। একে একে তাঁরা শামীম ওসমানের পা ধরে

সালাম করতে লাগলেন। তখনো নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি৷ কিন্তু কর্মীরা তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন৷ শামীম ওসমান তাঁদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘আমার কর্মীরা আমাকে ভালোবাসে। আমিও তাদের ভালোবাসি।’
বড় ভাই সেলিম ওসমান উপনির্বাচনে জিতলে দুই ভাই মিলে নারায়ণগঞ্জকে বদলে ফেলার কথাও বললেন শামীম ওসমান, ‘নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে ঢাকার স্কাই ট্রেন চালু করব। শীতলক্ষ্যার পারে শিল্পাঞ্চল করব। আমার ভাইয়ের সঙ্গে ওয়ালমার্টের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের আলাপ হয়েছে। তারা সেখানে বিনিয়োগ করবে৷ একটি ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে আলাপ হয়েছে, তারা একটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল করবে। এই সব করে আমি নেত্রীর কাছে তুলে দিয়ে রাজনীতি থেকে অবসরে যাব। নেত্রীর একজন কর্মী হিসেবে বাকি জীবন কাটাব।’
এই পর্যায়ে শামীম ওসমান ঘড়ি দেখলেন, তারপর মেঘলা হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর কুদরত, বৃষ্টি নামতাছে। নাইলে আজকা ওই মহিলার (মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী) খবর ছিল। আমার কর্মীদের বুকে তুষের আগুন জ্বলতাছে, ওই আগুন যদি আজকা জ্বইলা উঠত, তাইলে সবকিছু ছারখার হয়ে যেত। বৃষ্টি আইসা ওই আগুন একটু ঠান্ডা করছে।’
আবারও ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আওয়ামী লীগের ওই সাংসদ সাংবাদিকদের বললেন, ‘আপনারা এখন যান। আমার একজন “বাবা” আছে। আমি এখন নামাজ পড়ব। আমার বাবার সঙ্গে কথা বলব।’