ভাঙনকবলিত জনপদে বিষণ্নতার গান

‘সর্বনাশা নদীর জলে, আছানপুর করিল তল
আমরা খুঁজে পাই না মনোবল।
শুনেন আমার গানের ভাষা, মাছ ধরা ভাই আমরার পেশা
মাছ ধরিতে যাই আমরা, মনে থাকে কষ্টের ফল
আমরা খুঁজে পাই না মনোবল৷’
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার ভাঙনকবলিত আছানপুর গ্রামের নদীর পাড়ে বসে দরাজ গলায় এই গান করছিলেন নির্মল দাস। তিনি বাউলশিল্পী, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, এই গ্রামেরই সন্তান। সদ্য এই গানটি বেঁধেছেন। তিনি যখন এই গান গাইছিলেন, তখন তাঁর পাশ থেকে পাড়ের মাটির চাঙর ভেঙে নদীতে মিলিয়ে যাচ্ছিল। গান শুনে ৩০ থেকে ৩৫ জন বিষণ্ন শ্রোতার মুখ যেন আরও মলিন হয়ে ওঠে। গত শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে সরেজমিনে ওই গ্রামে এ দৃশ্য দেখা গেছে।
গ্রামের কয়েকজন জানালেন, বাউলের এই গানের কথার মতোই নদীভাঙনের কারণে তাঁদের জীবনে নেমে এসেছে বিপর্যয়। দুই সপ্তাহ আগ থেকে শুরু হওয়া নদীভাঙন কোনোভাবেই থামছে না। এরই মধ্যে গ্রামের ২২ জন ভিটেহারা হয়েছেন, অনেকের ঘর নদীতে তলিয়ে গেছে।
আছানপুরে প্রায় দেড় শ বছর আগে এই জনবসতি গড়ে ওঠে। অবস্থান ঘোড়াউত্তা নদীর মাঝে জেগে উঠা চরে। গ্রামটি উপজেলার দীঘিরপাড় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমান বাসিন্দা প্রায় তিন হাজার। এখানকার মানুষের একমাত্র পেশা মাছ ধরা।
দীঘিরপাড় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আমিন মোহাম্মদ বলেন, ‘এত দিন সরকারি উদ্যোগে বাঁশের পাইলিং দিয়ে গ্রামটি রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এবার আর সম্ভব নয়। বিষয়টি স্থানীয় সাংসদ আফজাল হোসেনের নজরে আনা হয়েছে। শুনেছি, কিছুদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিয়ে আছানপুরে যাবেন তিনি।’
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, লালহাটি, কোষাহাটি, টেক্কাহাটি ও কোম্পানীহাটি—এ চারটি পাড়া নিয়ে আছানপুর গ্রাম। গত দুই সপ্তাহে ভাঙতে ভাঙতে নদী গ্রামটির প্রায় ৮০ ফুট ভেতরে ঢুকেছে। এতে করে লালহাটি ও কোষাহাটি প্রায় বসতিশূন্য হয়ে পড়েছে। টেক্কাহাটি ও কোম্পানীহাটি আছে চরম ঝুঁকিতে। কৃষ্ণধন, যোগেশ, মনোজিৎ, সাচুনি, কৃষ্ণ, পীরেন্দ্র, নিপেন্দ্র, লিটন, রিপন, লালহিরা, রাজবিহারী, জয়চান, শচীন্দ্র, রতন, বলরাম, সুকাশ, সন্তোষ, শংকর, নিত্যলাল, মনিন্দ্র, উপানন্দ ও সুরেশ দাসের বসতভিটা ইতিমধ্যে নদীতে মিলিয়ে গেছে। এখনো যাঁদের ভিটা টিকে আছে তাঁরা ঘরগুলো সরিয়ে কিছুটা নিরাপদ জায়গায় নতুন করে বসতি গড়ার সংগ্রাম করছেন।
কথা হয় গৃহবধূ ইন্দুবালা দাসের (৫০) সঙ্গে। দুই বছরের ব্যবধানে ভাঙনের কবলে পড়ে দুইবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে তাঁকে। এবারও আছেন চরম ঝুঁকিতে। নদী তাঁর বসতভিটা থেকে মাত্র ১০-১২ ফুট দূরে। বিকল্প বসতির কোনো জায়গা না থাকায় এখনো তিনি ঘরটি সরিয়ে নিতে পারেননি।
ইন্দুবালা জানালেন, পরিবারের লোকজন নিয়ে দিনে খোলা জায়গায় ঘুমান, কিন্তু রাত কাটান নির্ঘুম।