দুর্দশায় ৫০ হাজার মানুষ

সাত দিন আগেও ভোলার সবচেয়ে বড় মাছঘাট এই সামরাজ বাজারে ছিল দুই শতাধিক ব্যবসায়ীর কয়েক শ আধা পাকা ঘর। আশপাশে ছিল কয়েক শ পরিবার। অস্বাভাবিক ভাঙন ও জোয়ারে এখন কিছুই নেই। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার অন্যত্র তাদের মালামাল সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ছবিটি গত বৃহস্পতিবার সামরাজ বাঁধ থেকে তোলা l প্রথম আলো
সাত দিন আগেও ভোলার সবচেয়ে বড় মাছঘাট এই সামরাজ বাজারে ছিল দুই শতাধিক ব্যবসায়ীর কয়েক শ আধা পাকা ঘর। আশপাশে ছিল কয়েক শ পরিবার। অস্বাভাবিক ভাঙন ও জোয়ারে এখন কিছুই নেই। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার অন্যত্র তাদের মালামাল সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ছবিটি গত বৃহস্পতিবার সামরাজ বাঁধ থেকে তোলা l প্রথম আলো

ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার দুটি ইউনিয়নের আটটি গ্রাম অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে দুর্দশায় পড়েছে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, প্রায় ৬ কিলোমিটার এলাকায় কোনো বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ না থাকায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
জোয়ারের পানিতে প্লাবিত চর মাদ্রাজ ও হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের অবস্থান চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ-পূর্বদিকে। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে সেখানকার মানুষের দুর্ভোগের চিত্র দেখা যায়।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অস্বাভাবিক জোয়ারের প্রবল ঢেউ শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রতিদিন এ দুটি ইউনিয়নের আটটি গ্রামে আঘাত হানছে। গ্রামগুলো হলো মোহাম্মদপুর, পূর্ব মাদ্রাজ, মিয়াজানপুর, চর আফজাল, চর নাজিমউদ্দিন, হামিদপুর, বেতুয়া, হাজারীগঞ্জ, কেরামতগঞ্জ ও চেয়ারম্যানের বাজার। এতে প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে বসতবাটি।
এলাকার চারদিকে এক অস্বাভাবিক ও দমবন্ধ পরিবেশ দেখা গেল। ভেঙে ও ডুবে যাওয়া বাড়িঘরের আসবাবপত্র নিয়ে সড়কে আশ্রয় নিয়েছে অনেক পরিবার। তাদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে সেখানকার পরিবেশ। উপড়ে যাওয়া বড় বড় গাছ নদী ও খালের পানিতে ভাসছে। জোয়ারে ভেঙে গেছে মোহাম্মদপুর গ্রামের নূরনবী ও আবদুল মান্নানের বাড়িঘর। সেসব বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ নৌকা দিয়ে এনে ট্রলিতে তুলছেন তাঁরা। জানতে চাইলে নূরনবী বলেন, ‘এই দ্যাশের খাওন আল্লায় শ্যাষ কইর্যাব দিছে, বাপ-দাদার ভিটা জমি সব মেঘনার প্যাডে, অ্যাহোন ল্যাতরা (একটি জায়গার নাম) যাই।’
নূরনবী ও আবদুল মান্নানের মতো বহু মানুষের বাড়িঘর ভেসে গেছে জোয়ারে। যাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, তারা বাঁধের ওপর ভাঙা ঘরের ধ্বংসাবশেষ ও আসবাব রেখে অন্যের বাড়িতে রাত কাটাচ্ছে। তাদের রাত-দিনগুলো কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে। পূর্ব-মাদ্রাজের রহিমা বিবি বলেন, ‘চুলা বিজা, লারকিও (জ্বালানি) বিজা, দুগা চাউল পাইছি, কিন্তুক রান্দোনের জাগা নাই, খামু কি?’ এ কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন রহিমা বিবি।
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আমনের বীজতলা, আউশের খেত, শসা-ধুন্দল, বেগুন, বরবটিসহ অনেকের সবজিবাগান পানিতে ডুবে আবার ভেসে উঠেছে। কোথাও কোথাও পানি সরাতে পাম্প বসানো হয়েছে। চরফ্যাশন বাজার থেকে সামরাজ যেতে সড়কের অন্তত ১১০টি স্থানে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। ইটভাটা, স মিল, রাইস মিলসহ অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পানির নিচে। মাটির রাস্তার কোনো চিহ্ন নেই। ডুবে আছে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। ডুবে থাকা কলগুলো মাথা উঁচিয়ে জেগে উঠেছে ময়লা গায়ে। শিশুরা গণহারে সর্দিতে আক্রান্ত হচ্ছে। কেরামতগঞ্জ বাজারের পল্লি চিকিৎসক আবুল কাশেম বলেন, ‘এলাকার বেশির ভাগ মানুষ জ্বর-ঠান্ডায় এবং শিশুরা পাতলা পায়খানা ও সর্দিতে আক্রান্ত হয়েছে।’
অস্বাভাবিক জোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ভাঙন। ভোলা জেলার সবচেয়ে বড় মাছ ঘাট সামরাজ স্লুইজ গেট। সেখানে প্রতিদিন চার-পাঁচ কোটি টাকা লেনদেন হয়। গত সাত দিনে এই ঘাটটি মেঘনায় সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। ঘাটের প্রবীণ মৎস্য ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন বলেন, অস্বাভাবিক জোয়ার ও মেঘনার ভাঙন ব্যবসায়ীদের ৩০ কোটি টাকার ক্ষতি করেছে। বাজারের খোরশেদ দরবেশের বরফকল, বন অফিস, পাউবোর অফিস, তোফায়েল মিয়া ও আবদুল মালেকের আড়তসহ অর্ধশতাধিক আধা পাকা ভবন মেঘনাগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
সামরাজ ঘাটের ব্যবসায়ী আবদুর রহমান, মো. ফারুক মিয়াসহ একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ডের আলস্যের কারণে আজ মানুষের এই দুরবস্থা। যথাসময়ে বাঁধ নির্মাণ করা হলে এই জোয়ারের পানি হয়তো ঠেকানো যেত। তিনি বলেন, পানিতে সবকিছু হারিয়ে গত ছয়-সাত দিন দুর্গত মানুষের গোসল, খাওয়া-দাওয়া, নামাজ-রোজা বন্ধ। ভাঙনে হাজার হাজার পরিবার নিঃস্ব।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হাকিম এই অভিযোগ মেনে নিয়ে বলেন, যথাসময়ে দরপত্র আহ্বানের পরও কেউ দরপত্র ক্রয় না করায় বাঁধ নির্মাণের কাজ হয়নি। তিনি বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে পূর্ণিমার প্রভাবে পানির উচ্চতা বেড়ে বিপৎসীমা ছাড়িয়ে গেছে। পানির উচ্চতা এখন গড়ে ৪ দশমিক ৩ থেকে ৫ মিটার। এর স্বাভাবিক উচ্চতা ২ দশমিক ৮ মিটার।
ভোলা জেলা সিভিল সার্জন ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘দুর্গত এলাকায় খাওয়ার স্যালাইন, পানি ও বিশুদ্ধকরণ বড়ি দেওয়া হচ্ছে। আর নলকূপগুলো ঠিক করতে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. সেলিম রেজা বলেন, দুর্গতদের মধ্যে টাকা ও চাল বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ে আরও ত্রাণের চাহিদা পাঠানো হয়েছে।