দুর্গম পাহাড়ে কষ্টের শিক্ষা

রুনা চাকমা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। প্রতিদিন দুই ঘণ্টার দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে উত্তর ভুষণছড়া থেকে বাঙে ভুষণছড়ার স্কুলে আসে সে। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক সময় সন্ধ্যা হয়ে যায়। প্রথম শ্রেণি থেকে এভাবে চলছে রুনার শিক্ষা-সংগ্রাম।
শুধু রুনা নয়, রাঙামাটির বরকল উপজেলার দুর্গম পাহাড়ের এই স্কুলের অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী প্রতিদিন তিন-চার মাইল পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে ভুষণছড়া স্কুলে আসে। বরকলের মতো একই চিত্র দেখা যায় বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি ও জুরাছড়িসহ অন্যান্য উপজেলায়ও।
পর্যাপ্ত স্কুলের অভাবে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বাদ পড়ছে অনেক শিশু। এই অবস্থায় ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপিত কিছু স্কুল আশার আলো দেখাচ্ছে। তিন পার্বত্য জেলায় এ রকম ৩৪১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। যেগুলোতে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করছে।
এ বিষয়ে এমজেএফের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ওয়াসিউর রহমান বলেন, ‘তিন পার্বত্য জেলায় আমরা বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে স্কুলগুলোকে নানাভাবে সহযোগিতা করছি।’
বরকলের দুর্গম পাহাড়ে বাঙে ভুষণছড়া কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্যক্তি উদ্যোগে। অর্থাভাবে মাঝে কয়েকবার বন্ধও হয়ে যায়। বর্তমানে এমজেএফের সহযোগিতায় টংগ্যা নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্কুলটি চালায়। স্কুলের নামে ৪০ শতক জমি দান করেছেন স্থানীয় শশাঙ্ক মোহন চাকমা নামে এক ব্যক্তি।
শশাঙ্ক চাকমা বলেন, ‘আমি নিজে লেখাপড়া করতে পারিনি। আমাদের আশপাশের তিনটি পাড়ার ছেলেমেয়েরা দীর্ঘদিন প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তাই এই স্কুল করার চিন্তা করি আমরা। পরে টংগ্যা স্কুলঘর করে দিয়েছে। এ ছাড়া স্কুলের নামে বাগানের জন্য অর্থ দিয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করছে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, টিন দিয়ে নির্মিত স্কুলঘরটিতে তিনটি কক্ষ। এই তিন কক্ষে দুজন শিক্ষক পাঠদান করছেন। আশপাশের তিনটি পাড়া থেকে পাহাড়ি শিশুরা স্কুলে এসেছে। প্রচলিত পড়ালেখার পাশাপাশি নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা নিচ্ছে শিশুরা।
স্কুল পরিচালনার জন্য একটি কমিটি রয়েছে। স্কুলের হলুদ ও আনারস বাগান থেকে উপার্জিত আয় দিয়ে শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার কাজটি তদারক করে ওই কমিটি। স্কুলটি এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে জানালেন পরিচালনা কমিটির সভাপতি সুশীল চাকমা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাঙামাটিতে ৬০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি ১৫৯টি বেসরকারি স্কুল রয়েছে। বেসরকারি স্কুলগুলো ব্যক্তিপর্যায়ে স্থাপিত হয়েছে।
রাঙামাটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ কে এম রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে যেখানে স্কুলের সুবিধা অপ্রতুল। ওই সব এলাকায় ব্যক্তিপর্যায়ে এবং কিছু এনজিও স্কুল করেছে। আমরা সেগুলোতে পাঠ্যবই দিয়ে থাকি।’
বান্দরবানেও পর্যাপ্ত স্কুল নেই। দুর্গম পাহাড়ের অনেক শিশু বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে এখনো। এখানকার সাত উপজেলায় সরকারি স্কুল রয়েছে মাত্র ৩৩৭টি। এ বিষয়ে জেলার ভারপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল আলম বলেন, ‘সরকারি স্কুলের বাইরে কিছু বেসরকারি স্কুল রয়েছে। কিছু স্কুল পাড়া থেকে দূরে। এখনো শতভাগ বাচ্চাকে স্কুলে আনা সম্ভব হয়নি।’
ভুষণছড়ার মতো আরেকটি দুর্গম স্কুল বান্দরবানের পবলা হেডম্যানপাড়া কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪১ জন। বাংলার পাশাপাশি ম্রো ভাষায়ও তাদের পাঠদান করা হয়। এমজেএফের সহযোগিতায় ম্রোচেট নামে একটি সংস্থা স্কুলটি চালায়। স্কুলের দুই শিক্ষকের বেতন এবং উপকরণ দেয় ম্রোচেট।
স্কুল শিক্ষিকা লিউরু ম্রো বলেন, ‘এই এলাকার আশপাশে স্কুল নেই। এখান থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে একটি স্কুল রয়েছে। ২০১০ সালে এই স্কুল হওয়ার আগে এখানকার বাচ্চারা প্রাথমিক শিক্ষা পেত না।’