কে বোঝাবে সুরাতুন্নেসাকে!

সুরাতুন্নেসার (ডান থেকে দ্বিতীয়) এক ছেলে, এক মেয়ে, জামাতা ও নাতি লঞ্চডুবির পর থেকে নিখোঁজ। তাঁদের শোকে পাগলপ্রায় তিনি। চার দিন ধরে কিছু খাচ্ছেন না, ঘুমাচ্ছেন না। বাড়ির সামনে বিছানা পেতে দিন–রাত নিথর হয়ে বসে থাকেন তিনি। তাঁকে কী বলে সান্ত্বনা দেবেন প্রতিবেশী ও স্বজনেরা l ছবি: প্রথম আলো
সুরাতুন্নেসার (ডান থেকে দ্বিতীয়) এক ছেলে, এক মেয়ে, জামাতা ও নাতি লঞ্চডুবির পর থেকে নিখোঁজ। তাঁদের শোকে পাগলপ্রায় তিনি। চার দিন ধরে কিছু খাচ্ছেন না, ঘুমাচ্ছেন না। বাড়ির সামনে বিছানা পেতে দিন–রাত নিথর হয়ে বসে থাকেন তিনি। তাঁকে কী বলে সান্ত্বনা দেবেন প্রতিবেশী ও স্বজনেরা l ছবি: প্রথম আলো

আড়িয়াল খাঁর সদ্য গড়ে ওঠা চরে টিনের চালার বাড়ি। বাড়ির সামনেই শীতলপাটিতে শোয়া মধ্যবয়সী সুরাতুন্নেসাকে ঘিরে গ্রামের জনা বিশেক নারী ও শিশু। চার দিন ধরেই সুরাতুন্নেসা কিছু খাচ্ছেন না, ঘুমাচ্ছেন না। তাঁর এক ছেলে, এক মেয়ে, জামাতা ও নাতি লঞ্চডুবির পর থেকে নিখোঁজ। গ্রামবাসী তাঁকে এভাবেই আগলে রেখেছেন।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা থেকে এই পরিবারটির ঠিকানা পাওয়া যায়। এরপর শিবচর বাজার থেকে ভাড়ার মোটরসাইকেলে সন্ন্যাসীর চরে। সন্ন্যাসীর চর বাজারে এসে সুরাতুন্নেসার খবর জানতে চাইতেই অনেক মানুষ ঘিরে ধরলেন। বাজারের সবাই এই পরিবারটিকে চেনেন, সবাই সমব্যথী।
তাঁরা জানালেন, মাত্র আড়াই মাস আগে আড়িয়াল খাঁর ভাঙনে পরিবারটি তাঁদের বসতবাড়ি হারিয়েছে। এখন নদীর ওই পাড়ে গড়ে ওঠা চরে নতুন বাড়ি করেছেন। সেই বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা জানতে চাইলে ১৫ জনের মতো মানুষ এগিয়ে এলেন রাস্তা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। তাঁরা চিনিয়ে নিয়ে যাবেন সেই বাড়িতে। আড়িয়াল খাঁর তীরে গিয়ে খেয়ানৌকায় পার হয়ে ধানখেত পেরিয়ে ধু ধু চরের ওপর বাড়িটি।
বাড়ির দিকে একদল গ্রামবাসীকে আসতে দেখে এগিয়ে আসেন বাড়ির বড় ছেলে হুমায়ুন। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ গ্রামবাসীকে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি, ‘ও কাকা, আমাগো কী হইল।’
সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর হুমায়ুন শার্টের পকেট থেকে চারজনের একটি ছবি বের করে দেখালেন। হাতে ধরে দেখালেন, ‘এই যে দেখেন, বাম দিকে এইডা আমার বোনজামাই ফরহাদ, এর পরে বোন শিল্পী, আর পাশেরডা আমার ছোট ভাই বেলাল। বেলালের কোলে বইনের পোলা ফাহিম। ঈদের ছুটিতে আইসা পাঁচ্চর বাজারের একটা স্টুডিওতে ছবিটা তুলছিল। এহন একটা লোকও নাই, ভাই। মা আমার চার দিন ধইরা কিছুই খাইতাছে না।’
বাড়ির সামনেই শোয়া অবস্থাতে সুরাতুন্নেসাকে দেখা গেল। হুমায়ুন বললেন, ‘মা, উইডা দেহো, সাংবাদিক আইছে।’
দুজন নারী ধরে সুরাতুন্নেসাকে আধশোয়া করতেই দুই হাত বাড়িয়ে এই নারী বলেন, ‘বাজান গো, আমার পোলা-মাইয়াগো লাশ আইন্যা দাও। তুমরা ঢাহায় থাহো, অনেক ক্ষ্যামতা তুমাগো। দ্যাশের প্রধানমন্ত্রীরে কও আমার পোলা-মাইয়ার লাশ আইন্না দিবো।’
এ সময় পাশের একজন নারী বললেন, ‘খালায় চার দিন ধইরা কিছু খায় না। না দানা, না পানি।’ সুরাতুন্নেসা বললেন, ‘আমার বুকের ধন গাঙে পইড়া রইছে। চাইরডা মানুষ নাই আমার পরিবারের। আমি ক্যামনে খাই।’
বড় ছেলে হুমায়ুন বলেন, ‘ভাই, লাশ না পাইলে আমার মায়েও বাঁচত না।’ তিনি জানান, তাঁরা তিন ভাই ও তিন বোন। এর মধ্যে নিখোঁজ দুজন সবার ছোট। এখন তিনি একাই বাড়িতে রয়েছেন, মায়ের জন্য। বাকি সবাই লাশের খোঁজে এদিক-ওদিক ছুটছেন।
হুমায়ুন জানান, শিল্পীর স্বামী ফরহাদের বাড়ি পাশের গ্রামেই। ফরহাদ রাজধানীর নবাবপুরে একটি ওয়ার্কশপে লেদ মেশিন চালান। পরিবার নিয়ে রাজধানীর রায়েরবাগে থাকতেন তিনি। আর ভাই বেলাল খিলক্ষেতের একটি সোয়েটার কারখানার কর্মী। ঈদের ছুটিতে সবাই মিলে বাড়িতে এসেছিলেন। ওই দিন সকাল আটটার দিকে তাঁরা বাসা থেকে বের হন। সকাল ১০টার দিকে লঞ্চে ওঠার পর বেলালের সঙ্গে কথা হয় হুমায়ুনের। লঞ্চডুবির কথা শোনার পরে ফোন দিয়ে দেখেন, সবার ফোনই বন্ধ।