ভাবনা জাগাক স্মৃতিস্থাপনা

স্বজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন মিশুক মুনীরের একমাত্র ছেলে সুহৃদ মুনীর। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ নিহত হন পাঁচজন। তাঁদের বহনকারী দুমড়েমুচড়ে যাওয়া মাইক্রোবাসটি দিয়েই তৈরি হয়েছে ‘সড়ক দুর্ঘটনা স্মৃতিস্থাপনা’। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুনাহার হল সংলগ্ন সড়কদ্বীপে স্থাপনাটি উদ্বোধনের পর তেলা ছবি l প্রথম আলো
স্বজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন মিশুক মুনীরের একমাত্র ছেলে সুহৃদ মুনীর। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ নিহত হন পাঁচজন। তাঁদের বহনকারী দুমড়েমুচড়ে যাওয়া মাইক্রোবাসটি দিয়েই তৈরি হয়েছে ‘সড়ক দুর্ঘটনা স্মৃতিস্থাপনা’। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুনাহার হল সংলগ্ন সড়কদ্বীপে স্থাপনাটি উদ্বোধনের পর তেলা ছবি l প্রথম আলো

কালো স্ফটিক পাথরের ওপর সাদা ভাস্কর্য। পাশে সবুজ গাছের সারি আর ওপরে নীল আকাশ। এমনই নিসর্গে স্থাপিত হলো ‘সড়ক দুর্ঘটনা স্মৃতিস্থাপনা’টি—তিন বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের শেষ কয়েকটি মুহূর্তের স্মারক।
এটি স্থাপিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলসংলগ্ন সড়কদ্বীপে। গতকাল সোমবার দুপুরে স্মৃতিস্থাপনার উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই চাই, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর যে মিছিল চলছে, তা যেন বন্ধ হয়ে যায়। সবাই নিজের দায়িত্ব পালন করলেই কেবল এটি সম্ভব।’
সেদিনের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে আসা ঢালী আল মামুন এ স্মৃতিস্থাপনার শিল্পী। বললেন, এটা পরিকল্পিত হয়েছে একই সঙ্গে একধরনের স্মৃতিচিহ্ন, স্মৃতিস্তম্ভ ও জাদুঘর হিসেবে। কোনো অর্থ আরোপের চেষ্টা এখানে করা হয়নি, ভাস্কর্যটি নিজেই অনেক অর্থবহ। সাধারণত এ ধরনের ভাস্কর্য জনবিচ্ছিন্ন হয়, কিন্তু এটি যাতে জনগণের কাছাকাছি থাকে, সেই চেষ্টা করা হয়েছে। আর নিসর্গ-নকশার রূপ দিয়েছেন স্থপতি সালাউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, চেষ্টা করা হয়েছে যেন এখানে স্থপতির কাজ হারিয়ে যায়। নিসর্গের মধ্যে এ স্থাপনা দেখে মানুষ যেন কিছু চিন্তা করে।
মিশুক মুনীরের ভাই আসিফ মুনীর বলেন, সরাসরি ভুক্তভোগী না হলে দুর্ঘটনায় এমন মৃত্যুর খবরে একধরনের নির্লিপ্ততা দেখা যায়। প্রতিক্রিয়াগুলো যেন নিছক টেলিভিশন সংবাদের স্ক্রলে চোখ বোলানো বা পত্রিকার পাতা ওল্টানোর মতো। কিন্তু এটা যদি বন্ধ করতে হয়, তবে নিজ নিজ জায়গা থেকে সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।

‘সড়ক দুর্ঘটনা স্মৃতিস্থাপনা’ উদ্বোধন শেষে ঘুরে দেখছেন (সামনে বাঁ থেকে) শিল্পী ঢালী আল মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ l ছবি: প্রথম আলো
‘সড়ক দুর্ঘটনা স্মৃতিস্থাপনা’ উদ্বোধন শেষে ঘুরে দেখছেন (সামনে বাঁ থেকে) শিল্পী ঢালী আল মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ l ছবি: প্রথম আলো

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ভোরে কাগজের ফুল চলচ্চিত্রের দৃশ্য ধারণের স্থান নির্বাচন করতে মানিকগঞ্জে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, চিত্রগ্রাহক ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ নয়জন। ফেরার পথে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকায় তাঁদের মাইক্রোবাসটিকে মুখোমুখি ধাক্কা দেয় উল্টো দিক থেকে আসা একটি বাস। সেখানেই মারা যান পাঁচজন। তারেক, মিশুক, মাটির ঘর নির্মাণকর্মী জামাল হোসেন, গাড়িচালক মুস্তাফিজুর রহমান ও কর্মী মোতাহার হোসেন ওরফে ওয়াসিম। আহত হন তারেকের স্ত্রী ও চলচ্চিত্রকার ক্যাথরিন মাসুদ, শিল্পী ঢালী আল মামুন ও তাঁর স্ত্রী শিল্পী দিলারা বেগম জলি। একমাত্র অক্ষত থাকেন কাগজের ফুল-এর সহকারী পরিচালক মনিস রফিক।
স্মৃতিস্থাপনার তিনটি অংশ। প্রথম অংশে আছে দুর্ঘটনার স্মারক মাইক্রোবাসটির মূল কাঠামো। সেটির কম ক্ষতিগ্রস্ত পাশটিতে ঝুলে থেকে পাঁচটি হাতের অবয়ব হারিয়ে যাওয়া জীবনগুলোর কথা বলছে। ভাস্কর্যের দ্বিতীয় অংশ গড়েছে গাড়ির ভেতর থেকে বের করে আনা আসনগুলো। সেগুলো স্থাপিত হয়েছে মাটির কয়েক ফুট ওপরে, যেন-বা ভাসমান। তৃতীয় অংশে পুরো সড়কদ্বীপে ছড়ানো গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ মনে করিয়ে দেয় ছিন্নভিন্ন জীবনের কথা। ভাস্কর্যের দুটি অংশে শিল্পী বসিয়ে দিয়েছেন দুটি ময়না পাখি। আর এভাবেই দুর্ঘটনার প্রামাণ্য তথ্যগুলো একটি কাহিনি হয়ে ওঠে।
তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়, স্মৃতিস্থাপনা নির্মাণের শেষ পর্যায়ের কিছু কাজ বাকি আছে। সর্বসাধারণের জন্য এটি উন্মুক্ত হবে আরও দিন পনেরো পরে।

বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুমড়ে গেছে মাইক্রোবাসটির ওপাশ। এপাশ অনেকটাই অক্ষত। তাতে প্রতীকী পাঁচটি হাত দিয়ে শিল্পী ঢালী আল মামুন নিহত পাঁচজনকে স্মরণ করলেন l ছবি: প্রথম আলো
বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুমড়ে গেছে মাইক্রোবাসটির ওপাশ। এপাশ অনেকটাই অক্ষত। তাতে প্রতীকী পাঁচটি হাত দিয়ে শিল্পী ঢালী আল মামুন নিহত পাঁচজনকে স্মরণ করলেন l ছবি: প্রথম আলো

ক্যাথরিন মাসুদ স্থাপনাটি নির্মাণ ও স্থাপনে বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব ব্যক্তি ও সংগঠন সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। সহযোগিতা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, বার্জার পেইন্টস, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ। অনুষ্ঠানে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের স্বজনদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ক্যাথরিন মাসুদ, মিশুক মুনীরের ছেলে সুহৃদ মুনীর, এম এম আকাশ, কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা প্রমুখ। আরও উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী কামাল হোসেন, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, খুশী কবির, সারা হোসেন। শিল্পীবন্ধুদের মধ্যে ছিলেন নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য্য, ওয়াকিল আহমেদ, দিলারা বেগম জলি, সাজ্জাদ শরিফ, মুনিরা মোরশেদ, শাহাদুজ্জামান, সাজেদুল আউয়াল, জাহিদুর রহিম, কামার আহমাদ প্রমুখ। আরও ছিল সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে গড়া শিক্ষার্থীদের সংগঠন অ্যাকসিডেন্ট অ্যাওয়ারনেস গ্রুপ।
বড় একটি কাজ শেষ হওয়ায় কেমন লাগছে জানতে চাইলে ক্যাথরিন মাসুদ বলেন, ‘একটা “রিলিফ” কাজ করছে। প্রায় দুই বছর ধরে এ কাজটি হচ্ছিল। আমরা চাই মানুষ এখানে আসুক। দেখুক, ভাবুক। পরিবেশটা অনেকটা ধ্যান করার মতো। এই নিসর্গ ও ভাস্কর্য মানুষের মনে একটা প্রভাব ফেলুক, যাতে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসে, “সড়ক খুন” কিছুটা হলেও যাতে কমে।’