তাজউদ্দীনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দূরত্ব সৃষ্টি করে বাকশাল

বাকশাল গঠন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের গুরুতর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় তাজউদ্দীন হতাশ হয়েছিলেন। এসব ঘটনা বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবন’ শীর্ষক বক্তৃতায় এ কথা বলেন। গতকাল শনিবার বিকেলে এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে এই বক্তৃতার আয়োজন করে তাজউদ্দীন আহমদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ফান্ড।
অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরের দিন প্রথম সাক্ষাতেই বুঝেছিলেন, তিনি (তাজউদ্দীন) তাঁর নেতার (বঙ্গবন্ধু) আস্থা হারিয়েছেন। দেশের প্রয়োজনে তাজউদ্দীন ঐতিহাসিক একটি দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এবং তা যোগ্যতার সঙ্গে পালন করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন এবং প্রাণ দিয়েছিলেন তার কারণও ইতিহাসে নিহিত। তিনি ইতিহাসে থাকবেন, সঙ্গী হবেন অগ্রগতির সংগ্রামে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় তাজউদ্দীন আশঙ্কা করেছিলেন, এতে হানাদারদের অনুচরেরা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর বাকশাল গঠনের পর তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘যেভাবে দেশ চলছে তাতে আপনিও থাকবেন না, আমারাও না। দেশ চলে যাবে আলবদর-রাজকারদের হাতে।’
তিনি বলেন, সাধারণ ক্ষমা, বাকশাল এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হওয়ার পর তাজউদ্দীন কিছু একটা আশঙ্কা করছিলেন। তিনি ১৯৭৪ সালে বিভিন্ন সময় তাঁর স্ত্রীকে বলেছেন, ‘তুমি বিধবা হতে চলেছ। মুজিব ভাই বাঁচবেন না, আমরাও কেউ বাঁচব না। দেশ চলে যাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে।’ তাঁর ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর ভুল যখন ভাঙল না, তখন তিনি তাঁর একজন হিতাকাঙ্ক্ষীকে বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই আমি যদি মারা যেতাম, তাহলে সেটাই বরঞ্চ ভালো হতো।’
তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, এটা অনিবার্য ছিল যে তাঁরা একসঙ্গে কাজ করবেন এবং কাজের মাধ্যমে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠবেন। তবে এই দুই নেতার সম্পর্কে অবনতির পেছনে খন্দকার মোশতাক, চার ছাত্রনেতা ও মুজিব বাহিনীর হাত ছিল।
অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণটি সাজিয়ে দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন। ২৫ মার্চ পর্যন্ত নেতারা কী করবেন, তা ছিল অনিশ্চিত। তবে একটা পরিকল্পনা ছিল আত্মগোপন করে তাঁরা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। সেই অনুযায়ী তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছিলেন। গিয়ে শোনেন তিনি বাড়িতেই থাকবেন, আত্মগোপনে যাবেন না। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত এল না। তাজউদ্দীন একটি লিখিত বিবৃতি ও বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর রেকর্ড করতে একটি টেপ রেকর্ডারও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাক্ষরও পেলেন না, কণ্ঠস্বরও পেলেন না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বাকশাল গঠনের পর রাজনীতিতে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হলো। জাসদ সেই জায়গাটা নিল। যদিও এই দলের নেতারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না। আওয়ামী লীগের বলয় থেকে বেরিয়ে আসার পেছনে জাসদের কোনো মতাদর্শিক বিরোধ ছিল না। ছিল স্বার্থের বিরোধ। এই দলের নেতারা ছিলেন মুজিব বাহিনীর। এঁদের আন্দোলন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বড় ধরনের ক্ষতি করেছে।
বক্তৃতা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হক। এতে বক্তব্য দেন অধ্যাপক আহমেদ আবদুল্লাহ জামাল, অধ্যাপক গোলাম রব্বানী এবং তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমদ।