অবশেষে পাঁচ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল

অবশেষে পাঁচ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করেছে সরকার। তবে ভুয়া সনদ নেওয়ার জন্য দুদকের সুপারিশ মেনে আর কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শেষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলেছে, প্রশাসনের এই শীর্ষ কর্মকর্তারা মুক্তিযোদ্ধা না হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। তাঁরা সরকারি নির্দেশনা, পরিপত্র ও আইন অমান্য করে অসদাচরণ করেছেন। সনদ বাতিলের পাশাপাশি তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেছে দুদক।
শীর্ষ কর্মকর্তারা হলেন স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজ উদ্দিন মিঞা, সদ্য ওএসডি হওয়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সচিব এ কে এম আমির হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান (বতর্মানে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় বেসরকারীকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান) এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ওএসডি) আবুল কাসেম তালুকদার।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) অনুমোদন না নিয়ে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলামের একক ক্ষমতাবলে গেজেট ও সাময়িক সনদ নিয়েছিলেন চার সচিব ও একজন যুগ্ম সচিব।
গতকাল রোববার জামুকার বৈঠকে সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘প্রথম আলোর প্রতিবেদনের সত্যতা মিলেছে দুদকের অনুসন্ধানে। আমরা দুদকের সুপারিশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। এরপর দুদকের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
মন্ত্রী বলেন, এই সচিবদের অনেকেরই এ বছর চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। সনদ বাতিলের ফলে তাঁরা আরও এক বছর বাড়তি চাকরি করার সুবিধা পাবেন না। এখন আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে আজ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হবে বলে মন্ত্রী জানান।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান প্রথম আলোকে বলেন, আইনানুযায়ী শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা যাবে। এ ছাড়া প্রতারণার প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রতারণার মামলাও করা যাবে। আর বিভাগীয় ব্যবস্থা তো নেওয়া যাবেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা একাধিক বার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে সচিবদের সনদ বাতিলের বিষয়ে ধীরগতিতে চলার পরামর্শ দেন। এ ছাড়া অভিযুক্তদের মধ্যে কয়েকজন সনদ বাতিল না করার জন্য বিভিন্নভাবে মন্ত্রণালয়ে তদবির করেছেন।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান গোয়েন্দা প্রতিবেদন জামুকাকে অবহিত না করেই সনদ নিয়েছেন। আর মুক্তিযোদ্ধা সচিব নিজেই জামুকার সদস্যসচিব হিসেবে নিজের সনদে সই করেছেন। অন্য তিনজনের আবেদন জামুকাতে পাঠানোই হয়নি।
সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের অপরাধের জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, শৃঙ্খলা বিধিমালা অনুযায়ী এই কর্মকর্তাদের এ রকম কর্মকাণ্ড অসদাচরণের মধ্যে পড়বে। এঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত বা অনুসন্ধানে প্রমাণিত হলে চাকরি থেকে বরখাস্তের দণ্ড আরোপ করা যাবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত বুধবার ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় পরদিন দুদকের চিঠি পেয়েছে। ‘চাকরির শেষ সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার হিড়িক’ শিরোনামে গত ২২ জানুয়ারি প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে পাঁচ সচিবের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এরপর দুদক এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে।
জামুকার সিদ্ধান্ত ছাড়া নেওয়া সব সনদ স্থগিত: মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত প্রায় ১৪ বছরে জামুকার সিদ্ধান্ত ছাড়া যাঁরা সনদ নিয়েছেন, তাঁদের সবার সনদ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সংখ্যা ৪০ হাজারের মতো। মন্ত্রী জানান, লাল মুক্তিবার্তা ও ভারতের কাছ থেকে পাওয়া প্রশিক্ষণ তালিকার এক লাখ ৪৪ হাজার ছাড়া অন্যদের সনদ স্থগিত করা হয়েছে। এঁরা ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত আপিল করতে পারবেন। তবে লাল মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত কোনো মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তা একই প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই করা হবে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর সুপারিশ করা ৯৬টি আবেদন জামুকার অনুমোদন ছাড়া সরাসরি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে ২০টি গেজেট করার জন্য না পাঠিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এসব আবেদন পুনরায় যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ওই সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত মোট মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়া হয়েছে প্রায় এক লাখ ৫২ হাজার। গত পাঁচ বছরে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময় সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। এর আগের সরকারের আমলে আরও ৪০ হাজার সনদ দেওয়া হয়। তবে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এখনো সনদ নেননি।
মহাজোট সরকার ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারীদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণ করে। এর আগে ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাঁদের অবসরের বয়সসীমা ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়। অবসরের বয়স বাড়ানোর পর ২১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারী তাঁদের সনদ প্রত্যয়নের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এর মধ্যে প্রায় সাত হাজার সনদে গলদ পাওয়ায় মন্ত্রণালয় সেগুলো প্রত্যয়ন করেনি। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে এক হাজার ৬৬৮ জনের সনদে গলদ ধরা পড়ে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৫২ জনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ সঠিক নয় বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে ভুয়া সনদধারী কারও বিরুদ্ধে এখনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।