বাসার ভেতরে দুই শিশুসহ ৪ জন খুন

ঢাকার কেরানীগঞ্জের কদমপুর এলাকার একটি বাসা থেকে গতকাল চারজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ l ছবি: প্রথম আলো
ঢাকার কেরানীগঞ্জের কদমপুর এলাকার একটি বাসা থেকে গতকাল চারজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ l ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি বাড়ি থেকে গতকাল বুধবার সকালে দুই শিশুসহ চারজনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, দু-তিন দিন আগে এদের শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। গতকাল রাত একটা পর্যন্ত এদের পরিচয় ও সম্পর্কের বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি।
নিহত ব্যক্তিরা রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাপুরের কদমপুর এলাকার ছয়তলা ভবনের দোতলায় ভাড়া থাকতেন। তবে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক সোহেল মিয়া এদের নাম-পরিচয় জানাতে পারেননি। তবে তিনি জানান, এক ব্যক্তি কাঁচামাল ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে দুই মাস আগে দোতলার একটি বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। নিহত বাকি তিনজন ওই ব্যক্তির স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে।
গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের এক কোণে পড়ে আছে একটি খালি আলনা। মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কাঁথা ও কাপড়চোপড়। পাশে একটি কাঠের চৌকি। এর নিচে জাজিম দিয়ে ঢাকা চারটি লাশ। শাড়ির টুকরা দিয়ে দুজনের হাত-পা ও মুখ বাঁধা। লাশগুলোয় পচন ধরেছে।
পুলিশের তথ্যমতে, নিহত পুরুষের বয়স ৩৮, নারীর বয়স ২৮, দুই শিশুর মধ্যে ছেলের বয়স আট ও মেয়ের দুই বছর হতে পারে। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। চারজনকেই শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে।
আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডের বাঁ দিকের একটি রাস্তা দিয়ে আধা কিলোমিটার গেলেই কদমপুর রাস্তার পাশে ছয়তলা বাড়ি। মালিক শামসুল হক সৌদি আরবে থাকেন। সোহেল মিয়া বাড়িটি তত্ত্বাবধান করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুই মাস আগে স্থানীয় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক আক্কাস আলী, আরেকজন অটোরিকশার চালক রফিকুল কাঁচামাল ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে নিহত ব্যক্তির জন্য বাসাভাড়া নিতে আসেন। তাঁকে বলা হয়েছিল, তিনি রফিকুলের আত্মীয়। আক্কাস স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় তাঁর কথামতো দুই মাসের অগ্রিম টাকা নিয়ে বাসাভাড়া দেওয়া হয়। প্রথম মাসে পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া দিলেও পরের মাসে দুই হাজার টাকা দেন তিনি। বাকি টাকা পরে দেবেন বলে জানান।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামালউদ্দিন মীর বলেন, দু-তিন দিন আগে এ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আক্কাস ও তাঁর বন্ধু রফিককে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এঁদের পরিচয় জানা যাবে। আক্কাস ও বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক সোহেল মিয়াকে আটক করা হয়েছে। রফিককে পাওয়া যায়নি।
আটক হওয়ার আগে সোহেল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, গত মঙ্গলবার বিকেলে গিয়ে দেখেন, উত্তর পাশের ওই ফ্ল্যাটটি তালা লাগানো। গতকাল সকাল ১০টার দিকে গিয়ে দেখেন, দরজার বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগানো। ছিটকিনি খুলে ডাকাডাকি করে কারও কোনো শব্দ পাননি তিনি। শোবার ঘরে ঢুকে দেখতে পান, কাঠের চৌকির নিচে জাজিম দিয়ে ঢাকা একজনের মাথা বেরিয়ে আছে। তিনি চিৎকার দিলে ভবনের ও আশপাশের বাসিন্দারা ছুটে আসেন। এরপর কাঠের চৌকি কাত করে ফেললে দেখা যায়, চারজনের লাশ পড়ে আছে।
সোহেল জানান, তিনি বাড়িটি দেখাশোনা করলেও রাতে বাড়ির মালিক শামসুল হকের আবদুল্লাপুরের বাড়িতে থাকেন। ভাড়াটেদের কাছে ফটকের চাবি আছে। তাঁরা রাতে ফটকে তালা লাগিয়ে দেন।
তেঘরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য বাবুল দেওয়ান খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান এবং দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি জামালউদ্দিন মীরকে ফোন করে ঘটনা জানান। এরপর ওসির নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) শনাক্তকরণ দল প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করে। র্যা বের সদস্যরাও ঘটনাস্থলে যান।
নিহতদের পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হাসিনা বেগম জানান, নতুন এই ভাড়াটিয়ারা কারও সঙ্গে মিশতেন না। চার-পাঁচ দিন ধরেই বাসার বাইরে থেকে তালা লাগানো দেখা গেছে।
বাড়ির নিচতলায় দুটি দোকান রয়েছে। মুদি দোকানি দুলাল ব্যাপারী বলেন, তাঁদের দোকানের সামনে দিয়েই বাড়ির ভেতরে যাতায়াত করতে হয়। ওই পরিবার দোতলায় থাকলেও নিচতলার দুটি দোকান থেকে কিছু কিনত না। বাইরে থেকে বাজার আনতেও কখনো দেখা যায়নি। তবে দিন ১৫ আগে দোতলার ওই নারী দুই বছরের এক শিশুকে কোলে নিয়ে এসে এক প্যাকেট চিপস কিনেছেন। দুলাল বলেন, তিনি প্রতিদিন সকাল আটটায় দোকান খোলেন। রাত আটটার মধ্যে দোকান বন্ধ করে চলে যান।
দুলাল ব্যাপারী আরও বলেন, মাঝেমধ্যে এই বাড়িতে বোরকা পরা দুই নারী ও মোটা করে দুই ব্যক্তি আসতেন।
পুলিশ ওই বাসা থেকে ২০ টাকার নোট মুড়িয়ে বানানো নল, সিমবিহীন একটি মুঠোফোন, একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স ও একটি জাতীয় পরিচয়পত্র জব্দ করে। তবে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্রে ভিন্ন দুই ব্যক্তির নাম-ঠিকানা আছে।
দুই কক্ষের ওই বাসায় গিয়ে কোনো মালামাল চোখে পড়েনি। রান্নাঘরেও রান্নার কোনো সরঞ্জাম চোখে পড়েনি। কোনো চুলাও ছিল না। অপর কক্ষে বেসিনের ওপর কোমল পানীয়ের খালি একটি ছোট বোতল দেখা গেছে।
জানতে চাইলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত। পরিচিত লোকজনই এর সঙ্গে জড়িত বলে মনে হচ্ছে। সিএনজিচালক রফিককে পাওয়া গেলে নিহত ব্যক্তিদের পরিচয়সহ ঘটনার বিস্তারিত বেরিয়ে আসবে।
সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি শেষে গতকাল বিকেল চারটায় লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে।