সমুদ্রের মাঝখানে দাড়িয়ে...

দূর থেকে দেখে মনে হবে যেন উৎ​সব চলছে নদীর তীরে। রাতের কর্ণফুলীর এমন দৃশ্য মন ভরায় পর্যটকদের l সৌরভ দাশ
দূর থেকে দেখে মনে হবে যেন উৎ​সব চলছে নদীর তীরে। রাতের কর্ণফুলীর এমন দৃশ্য মন ভরায় পর্যটকদের l সৌরভ দাশ

তীরে দঁাড়িয়ে বহুবার সূর্যাস্ত দেখেছি। ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা জলের অতলে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। এই চিত্র, এই দৃশ্য আমরা সচরাচর সৈকতেই দঁাড়িয়ে দেখি। কিন্তু এ রকম যদি হয়, আপনি আছেন সমুদ্রের মাঝখানে; গোধূলির সূর্য তার রাঙা আলোয় রাঙিয়ে দিয়েছে সমুদ্র আর আপনাকে। চারপাশে শুধু ঢেউ আর ঢেউ। একসময় দেখবেন, ধীরে ধীরে সূর্যটা যেন গিলে খাচ্ছে রাঙা জলের সমুদ্রটি। মুহূর্তটি যেন কেটে যাবে ঘোরের মধ্যেই।
ঘোর কাটতেই আরেক বিস্ময়। পাল্টে গেছে সমুদ্রের রং। চারদিকে অন্ধকার। সন্ধ্যা নেমেছে। তখন চারপাশে আরেকবার তাকিয়ে দেখুন, দেখবেন বহির্নোঙরে অতিকায় জাহাজগুলোয় দূরের নক্ষত্রের মতো জ্বলে উঠেছে বাতি। এবার পেছনে ফেরা—কর্ণফুলীর নদী আর বঙ্গোপসাগরের মোহনার দিকে। একি! কোথাও যেন একটা উৎসব হচ্ছে। সেই উৎসবে জ্বলছে তারাবাতি। এসব জাহাজের বাতি। এ রকম একটা উৎসবের আমেজে আপনি ফিরে আসবেন। সমুদ্র দর্শনের এই সুযোগ করে দিয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিন সার্ভিস। তাদের প্রমোদতরি ওয়েস্টার্ন ক্রুজ অনুকূল আবহাওয়ার দিনগুলোয় সপ্তাহে দুদিন করে ভ্রমণপিপাসুদের সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যায়। সঙ্গে থাকে আনন্দের নানা অনুষঙ্গ। জাদু দেখানো, গান শোনানো ইত্যাদি।
ওয়েস্টার্ন ক্রুজের মতো পর্যটনবান্ধব আরও উদ্যোগ এই শহরের মর্যাদা যেমন বাড়াতে পারে, তেমনি আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে। প্রকৃতি আমাদের যেমন অনেক দিয়েছে, তেমনি ঐতিহাসিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা ও এলাকা। উদ্যোগের অভাবে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণহীন হয়ে পড়ে আছে। এই শহরের প্রান্তে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত। নদী ও সমুদ্রের মহামিলনের স্থান। শহর ছাড়িয়ে কিছুদূর গেলে পারকি সৈকত। শহরের মাঝখানেই রয়েছে নয়ন–ভোলানো হ্রদ ফয়’স লেক। সেখানে রয়েছে বিনোদনের মহা আয়োজন। মূল শহরে প্রবেশের আগেই সীতাকুণ্ডে ইকো পার্ক, প্রাচীন চন্দ্রনাথ মন্দির ও বৌদ্ধমন্দির। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে শিবচতুর্দশী মেলায় লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয়। শহরে

পানির ওপর কুঁড়েঘর l প্রথম আলো
পানির ওপর কুঁড়েঘর l প্রথম আলো

রয়েছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে স্মৃতিবিজড়িত ওয়্যার সিমেট্রি। বার আউলিয়ার মাজার। ভাটিয়ারি মিলিটারি একাডেমি। আগ্রাবাদের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর। জিয়া স্মৃতি জাদুঘর। বাটালি পাহাড়। চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। আগ্রাবাদ ও কাজীর দেউড়ি শিশুপার্ক। বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার। আমানত শাহের মাজার। বিপ্লব উদ্যান। পতেঙ্গা প্রজাপতি পার্ক। কালুরঘাট স্বাধীনতা পার্ক। পাহাড়ঘেরা জোবরা গ্রামে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। শহর থেকে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা যাত্রায় কাপ্তাই হ্রদ। বাঁশখালী ইকো পার্ক। মিরসরাইয়ের মহামায়া প্রকল্প।
এত্ত কিছু আছে। অথচ এসব প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থান-স্থাপনাকে আকর্ষণীয় করতে সরকারি, বেসরকারি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কোনো উদ্যোগ নেই। অন্যান্য জেলার তুলনায় চট্টগ্রামের পর্যটন নানাভাবে অবহেলার শিকার। একমাত্র মোটেল সৈকতটি ভেঙে ফেলার পর এক যুগ পেরিয়ে গেছে। বিনির্মাণের কাজ চলছে তো চলছেই। নতুন কোনো পর্যটন স্পট তৈরি তো হচ্ছেই না। পুরোনোগুলোও সংস্কার হচ্ছে না। চট্টগ্রামের পর্যটন স্পটগুলো দেখানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। শহরের বড় হোটেলগুলো তাদের অতিথি কিংবা স্থানীয় পর্যটকদের জন্য কোনো যানবাহনের ব্যবস্থা রাখেনি। কোনো প্রতিষ্ঠান নিজস্ব উদ্যোগে কিংবা পর্যটন করপোরেশন কি এই শহরে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে একটি পর্যটক–বাস চালু করতে পারে না? আমাদের সবকিছু আছে, কিন্তু সেগুলো যথাযথ ব্যবহার করতে পারছি না। আমাদের অবস্থা হয়েছে সেই হতভাগ্য গোয়ালার মতো। যার দু–তিনটে দুধেল গাই আছে, কিন্তু সেই দুধ রাখার পাত্র নেই অথবা বিপণনের কোনো ব্যবস্থা নেই। সুষ্ঠু তদারকি আর যথাযথ ব্যবহার করতে পারলে চট্টগ্রামই হতে পারে পৃথিবীর বিখ্যাত এক পর্যটন শহর। তখন সমুদ্রের মাঝখানে দঁাড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার মতো আরও বিচিত্র সুন্দর অভিজ্ঞতা এখানেই পাওয়া যাবে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় কচ্ছপ ভাস্কর্য l প্রথম আলো
বিশ্বের সবচেয়ে বড় কচ্ছপ ভাস্কর্য l প্রথম আলো