মানুষ অসহিষ্ণু, নৃশংসতা বাড়ছে

চলতি বছরের আট মাসে শুধু রাজধানীতেই ১৭১ জন খুন হয়েছেন। লাশ মিলছে শয়নকক্ষে, রাস্তায়, বস্তায় ভরা, আলমারির ভেতরেও। সাম্প্রতিক খুনের ঘটনাগুলোর ধরন অন্য সময়ের সঙ্গে মিলছে না। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ খুব অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। তুচ্ছ কারণে খুনের মতো ঘটনা ঘটছে। নিষ্ঠুরতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নূরুল হুদা এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষ ডেসপারেট (বেপরোয়া) হয়ে যাচ্ছে। সুকুমার বৃত্তিগুলো কমে যাচ্ছে। তবে এর চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা আগে ঘটেছে। খুনের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে আগে থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তবে বিচার বা শাস্তি না হওয়া এসব অপরাধের নেপথ্য কারণ হতে পারে। ২০ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর পূবালী এলাকায় সুরভী আক্তার নামের এক গৃহবধূকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে খুন করেন তাঁর স্বামী সাজ্জাদুল ইসলাম। এরপর পৌনে চার বছর বয়সী ছেলে ও ১৫ দিন বয়সী মেয়েকে লাশের পাশে রেখে ঘরে তালা মেরে পালিয়ে যান। পরদিন ২১ সেপ্টেম্বর সকালে গিয়ে পুলিশ দরজা ভেঙে লাশ ও শিশু দুটিকে উদ্ধার করে। ওই দিনই বিকেলে যাত্রাবাড়ী থানায় গিয়ে নিজের দোষ স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করেন সাজ্জাদুল।
১৮ সেপ্টেম্বর বুড়িগঙ্গায় একটি ভাসমান বস্তা থেকে সোহেল মিয়া নামের এক যুবককে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে সুস্থ হয়ে সোহেল জানান, তাঁর বন্ধু আমিন মিয়ার কাছে তিনি ২০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন। সেই টাকা আত্মসাৎ করতে আমিন কিছু লোকজন নিয়ে তাঁকে বস্তায় ভরে পানিতে ফেলে দেন।
১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ওয়ারীর ভগবতী ব্যানার্জি সড়কে আলমারির মধ্যে এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। পরে জানা যায়, নিহত মো. মন্টু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ব্যবসায়ী। তিনি গত ৩০ আগস্ট আম বিক্রির টাকা নিতে যাত্রাবাড়ীর আম ব্যবসায়ী হিমেল হাসানের বাসায় যান। টাকা না দিতে হিমেল তাঁর স্ত্রী ও অন্য সহযোগীদের নিয়ে ঘুমন্ত মন্টুকে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ রাস্তায় ফেলে রেখে যান। এ ঘটনায় পুলিশ স্ত্রীসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করলেও ব্যবসায়ী হিমেল পলাতক।
শুধু এ ধরনের অপরাধই নয়, গত কয়েক মাসে বাসাবাড়িতে ঢুকেও বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর গোপীবাগে বাড়িতে ঢুকে কথিত পীর লুৎফোর রহমানসহ ছয়জনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। তাঁর পরিবারের শিশু ও নারী সদস্যদের পাশের ঘরে বেঁধে রেখে এ লোমহর্ষক ঘটনা ঘটানো হয়। গত ২৭ আগস্ট রাতে একই কায়দায় রাজধানীর রাজাবাজারে বাসায় ঢুকে পরিবারের সদস্যদের অন্য ঘরে বেঁধে রেখে একইভাবে হত্যা করা হয় টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান উপস্থাপক নুরুল ইসলাম ফারুকীকে। এখনো এ হত্যার কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।
ফারুকী হত্যা মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, এ হত্যার জন্য তাঁরা দুটি জঙ্গি সংগঠনকে সন্দেহ করছেন। তবে তিনি ওই সংগঠন দুটির নাম প্রকাশ করেননি।
গত ২৮ আগস্ট রাজধানীর মগবাজারে বাসায় ঢুকে তিনজনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ, ডিবি ও র্যা ব মিলে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ওই মামলার এজাহারভুক্ত প্রধান আসামি ও সন্দেহভাজন শাহ আলম ওরফে কালা বাবু ১৫ সেপ্টেম্বর ডিবির কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
গত ১৪ জুন কালশীতে সেলুনের কর্মী মো. ইয়াছিনের স্ত্রী, কন্যা, নাতি-নাতনিসহ নয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু ওই ঘটনার একজন আসামিকেও এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। সর্বশেষ ৬ সেপ্টেম্বর ওই পরিবারের বেঁচে থাকা সদস্য মো. ইয়াছিনও বাসের চাপায় নিহত হন। কালশী বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দাদের দাবি, ইয়াছিন ১৪ জুনের হামলাকারীদের ছবি ধরে শনাক্ত করে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ কারণেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
রাজধানীর সাম্প্রতিক অপরাধ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গুলি-বোমা মেরে মানুষ খুন করে টাকা লুটে নেওয়ার কয়েকটি ঘটনা পর পর ঘটেছে। ৪ সেপ্টেম্বর গোড়ান ফায়ার স্টেশনের সামনে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী ইসরাইল হোসেন ও তাঁর ছেলে শরীফ হোসেন সায়মনকে গুলি করে ৩৮ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। বুকে গুলি লেগে ছেলে শরীফ মারা যান। ওই ঘটনায় ডিবি সিরাজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। ডিবির দাবি, সিরাজুলের মুঠোফোন থেকে ওই হত্যা ও ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত তিনটি অস্ত্রের ছবি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এখনো ওই অস্ত্র ও হত্যায় অংশ নেওয়া বাকিদের ধরতে পারেনি ডিবি।
এর আগে ১৯ আগস্ট রাজধানীর মগবাজারে গুলি করে ও বোমা ফাটিয়ে জে আর করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ৩০ লাখ ৬০ হাজার টাকা লুটে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। গত ৩ জুলাই উত্তরায় নিরাপত্তাকর্মীকে গুলি করে হত্যা করে এক কলেজছাত্রীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনার প্রধান সন্দেহভাজন গিয়াসউদ্দীন ওরফে আপন নামের এক যুবক ডিবির কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই অস্থির সামাজিক পরিবর্তনে মানুষের জীবনধারা বদলে যাচ্ছে। অপরাধের ধরনের মধ্যেও বিচিত্রতা আসছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, রাজধানীতে সাম্প্রতিক যে খুনের ঘটনা, তা সংখ্যার দিক থেকে খুব বেশি নয়। গত আট মাসে ১৭১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে খুন হয়েছেন ১৭৮ জন। মহানগরে এমনিতেই মাসে গড়ে ২৫টি করে খুন হয়। কিন্তু সেই সময় ঘটনার ভয়াবহতা ছিল কম। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ঘটছে ব্যক্তিগত কারণে। এগুলো কোনো সংঘবদ্ধ অপরাধ নয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, এখন তুচ্ছ ঘটনাতেও মানুষ খুন হচ্ছে। খুনের ক্ষেত্রে এমন অপরাধী পাওয়া যাচ্ছে, জীবনে যাদের এটাই প্রথম কোনো অপরাধ। এ ধরনের অপরাধ পুলিশের দ্বারা প্রতিরোধযোগ্য নয়। তবে বিচার-প্রক্রিয়া আরেকটু ত্বরান্বিত হলে শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতো, অপরাধও কমে যেত।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম মনে করেন, ‘মানুষ সংবেদনশীলতা হারাচ্ছে, অসাড় হয়ে যাচ্ছে। আগে একটি অস্বাভাবিক ঘটনায় মানুষের যে অনুভূতি প্রকাশ পেত, এখন তা ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম অসাড়তা নিয়ে বেড়ে উঠছে। যার ফলে আমরা অনেক নিষ্ঠুর ও বিচিত্র ধরনের অপরাধ দেখছি।’