নতুন ঠিকানায় আয়েশা ফয়েজ

বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদের ছবির সামনে ছোট ছেলে আহসান হাবীবের সঙ্গে অায়েশা ফয়েজ। ৬ জুলাই ঢাকার পল্লবীর বাসা​ থেকে ছবিটি তুলেছেন আলোকচিত্রী কবির হোসেন
বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদের ছবির সামনে ছোট ছেলে আহসান হাবীবের সঙ্গে অায়েশা ফয়েজ। ৬ জুলাই ঢাকার পল্লবীর বাসা​ থেকে ছবিটি তুলেছেন আলোকচিত্রী কবির হোসেন

দেয়ালে হুমায়ূন আহমেদের বড় একটা ছবি। ঘরের দরজা গলে বাইরে তাঁর অপলক দৃষ্টি। আমরা তাকিয়ে ছিলাম ছবিটার দিকে। ঠিক সে সময় মৃদু পায়ে ঘরে এলেন আয়েশা ফয়েজ। পেছনে ছোট ছেলে আহসান হাবীব। কেবল হাঁটতে শিখেছে, এমন শিশুকে যেভাবে ধরে রাখা হয়, সেভাবেই মাকে ধরে রেখেছেন। স্পষ্টই বোঝা গেল, আয়েশা ফয়েজের শরীর খুব ভালো নেই। মুখের মানচিত্রেও সেটার ছাপ। তার পরও তিনি ঘরে ঢুকতেই মনে হলো দেয়ালে টাঙানো হুমায়ূন আহমেদের ছবিটাও জীবন্ত হয়ে উঠেছে!

গত ৬ জুলাই আমরা গিয়েছিলাম ঢাকার পল্লবীর ওই ছিমছাম বাসায়। সেই বাসায় আহসান হাবীবের সঙ্গে থাকতেন আয়েশা ফয়েজ; এখন আর থাকেন না! সেদিন যখন ওই বাসায় পা রাখলাম, তখন বাসার সামনের ছোট্ট চৌবাচ্চার স্বচ্ছ জলে বেশ কটা রঙিন মাছ ছুটে বেড়াচ্ছিল। ২৭ সেপ্টেম্বর আবার যখন সেখানে গেলাম, তখন চৌবাচ্চার জলে অনেক পাতা জমেছে, মাছগুলোও ঝিম মেরে আছে! ওরাও কি ততক্ষণে বুঝে গেছে, এ বাসার মা আর নেই!

আয়েশা ফয়েজের লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ
আয়েশা ফয়েজের লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ

৬ জুলাই আমরা গিয়েছিলাম আহসান হাবীবের জীবনযাপন নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে। কিন্তু কথা শুরু হলো আয়েশা ফয়েজের সঙ্গে। ঠিক সাক্ষাৎকার নয়, খুব সাধারণ কথাবার্তা হচ্ছিল। কী মনে করে যেন মুঠোফোনের রেকর্ডারটি চালু করেছিলাম! ২৭ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুর খবরটি শোনার পর আমরা আবার রেকর্ডটি শুনলাম। যেখানে তিনি বলছিলেন, ‘সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। শরীর ভালো লাগে না। সময় কাটে না। খুব খারাপ লাগে!’ অখণ্ড অবসরে কী করেন? আমরা তো জানি আপনার বই পড়ার খুব শখ। শেলফের বইগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এখন আর বই পড়তেও ভালো লাগে না। আগে তো অনেক ভারতীয় লেখকের বই পড়তাম আগ্রহ নিয়ে। পরে যখন ছেলেরাই লেখক হয়ে গেল, তখন ওদের বই পড়েই সময় কেটে যেত।’ মনে পড়ে গেল আরও বছর দুই-তিনেক আগের কথা। সেবার আমরা তাঁর কাছে গিয়েছিলাম তিন ছেলেকে নিয়ে কিছু শোনার আশায়। তখনই বলেছিলেন তাঁর প্রিয় লেখক বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদ। দ্বিতীয় পছন্দ মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আর তৃতীয় পছন্দ তৃতীয় ছেলে আহসান হাবীবের লেখা। এবারও একই কথা বললেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, ‘অনেক গরম পড়েছে, না? খুব তো বৃষ্টি হলো কিন্তু গরম কমল না। আর দেখো, ঠিক এই বর্ষায় রাস্তাঘাটের কাজ শুরু করেছে! কবে যে এই রাস্তাটা ভালো হবে, আল্লাহই জানেন।’ আসলেই পল্লবীর ওই রাস্তাটার অবস্থা তখন খুব খারাপ। খোঁড়াখুঁড়ি করে একাকার। কিন্তু রাস্তার খবর কী করে পেলেন আপনি? এখন কি বাইরে বেরোতে যান? মুখটা আবার মলিন হলো আয়েশা ফয়েজের, ‘নাহ্, বাইরে যাওয়ার তেমন শক্তি পাই না তো। ঘরেই সময় কাটে।’ আয়েশা ফয়েজের লেখা বই জীবন যে রকম-এ আমরা পড়েছিলাম, তাঁর শ্বশুর একবার বলেছিলেন, ‘আম্মা, আমি কাঙাল মানুষ, আল্লাহর কাছে ধন চাই নাই, শুধু জন চেয়েছি। আল্লাহর কাছে দুই জিনিস চাওয়া যায় না।’ শ্বশুরের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখেছিলেন আয়েশা ফয়েজ তাঁর সংসারে। ছয় ছেলেমেয়ে, ঘরজুড়ে নাতি-নাতনি, তাঁদের ছেলেমেয়ে। উত্তর জানা, তার পরও প্রশ্ন করি, অবসরে তাঁদের সঙ্গ কেমন লাগে? এবার মুখে খানিকটা হাসি খেলে গেল, বললেন, ‘তাদের সঙ্গ তো দুনিয়ার সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার। কিন্তু এখন তো বাচ্চারাও পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত।’ বলতে বলতে হুমায়ূন আহমেদের ছবিটার দিকে তাকালেন আয়েশা ফয়েজ। মুহূর্তেই চোখ ছলছল। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে নিজে নিজেই বলে উঠলেন, ‘সময় যখন আর কাটে না, তখন এই ছবিটার সামনে আসি। যখনই ভাবি, আমি আছি কিন্তু আমার ছেলে নাই, তখন আর দুনিয়ার কিচ্ছু ভালো লাগে না। মন চায় তার কাছে চলে যাই!’

২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪। প্রিয় ছেলের কাছেই চলে গেলেন আয়েশা ফয়েজ!