মানব পাচার থামছে না

কক্সবাজার উপকূল হয়ে মানব পাচার থামছে না। আগে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাসহ এই অঞ্চলের মানুষ নৌকায় করে মালয়েশিয়ায় যাত্রা করত। এখন রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, যশোর, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনাসহ দেশের ১৯ জেলার মানুষ যাচ্ছেন।
কিছু মানুষ থাইল্যান্ড পৌঁছে মোটা অঙ্কের টাকা পরিশোধ করে গন্তব্যে পৌঁছালেও অনেকেই ট্রলারডুবির ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। অনেকে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকে ধরা পড়ে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। অধিকাংশ দালাল যাত্রীদের সমুদ্রে নিয়ে জলদস্যুদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। দস্যুরা বেদম পিটিয়ে যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করছে। জলদস্যু, সন্ত্রাসী বাহিনী আর দালালের যোগসাজশে চলছে উপকূলে মানব পাচারের রমরমা বাণিজ্য।
এই পথে প্রতি মাসে কতজন মালয়েশিয়া যাচ্ছেন, তার সঠিক হিসাব সরকারি কোনো সংস্থা বলতে পারেনি। তবে মানব পাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, গত তিন বছরে সমুদ্রপথে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ মালয়েশিয়ায় রওনা দিয়েছেন। এর মধ্যে একাধিক ট্রলারডুবির ঘটনায় অন্তত ৫০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ। উপকূলে অনুসন্ধান চালিয়ে তাঁরা এই তথ্য পেয়েছেন বলে জানান।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন বলেন, উখিয়া-টেকনাফের দুটি শিবিরে ৩০ হাজার শরণার্থী ছাড়াও জেলার পাহাড়-জঙ্গলে অবৈধ বসতি করছে মিয়ানমারের আরও চার লাখের বেশি অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা। কাজের সন্ধানে অথবা প্রতারণার শিকার হয়ে দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়ার উদ্দেশে সাগরে নেমে বিপদে পড়ছেন। নানাভাবে চেষ্টা করেও এই তৎপরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
কিছু ঘটনা: গত ৩ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে পুলিশ চকরিয়া পৌরসভার পালাকাটা এলাকা থেকে ১৯ জনকে আটক করে। সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লা ও যশোরের এই বাসিন্দারা মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন।
আটক যাত্রী সিরাজগঞ্জের রফিকুল ইসলাম (২৭) ও তারা মিয়া (৪০) জানান, জসিম উদ্দিন নামের এক দালাল মাথাপিছু ১০ হাজার টাকা করে নিয়ে তাঁদের ঢাকা হয়ে কক্সবাজার নিয়ে আসেন। রাতে সাগরে নিয়ে তাঁদের দস্যুদের হাতে তুলে দেন। দস্যুরা টাকাপয়সা লুট করে তাঁদের ছেড়ে দেয়।
যশোরের রিপন হোসেন (১৮) ও কুমিল্লার এরশাদ (৩০) বলেন, দস্যুরা তাঁদের মারধর করলেও দালাল জসিমকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়। দালালরা দস্যুদের পূর্বপরিচিত বলে তাঁদের ধারণা। অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় যাত্রা প্রসঙ্গে রিপন ও এরশাদ বলেন, ‘মাত্র ১০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া যাওয়া—এটা ছিল আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো। কিন্তু পুরোটাই যে প্রতারণা, তা ধরা না পড়লে বুঝতাম না।’
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত ৩ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের মাগুরা এলাকার নয়জন যাত্রীকে মালয়েশিয়ায় পাচারের জন্য কক্সবাজারে নিয়ে আসেন সেখানকার দালাল (মাগুরা এলাকার) সাগর বিশ্বাস। ৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে যাত্রীদের শহরের এলিনপার্ক হোটেলে নিয়ে স্থানীয় (কুতুবদিয়াপাড়ার) আরেক দালাল মো. মোস্তফার কাছে বিক্রির সময় পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে।
হবিগঞ্জের যাত্রী জামাল উদ্দিন (২৩) ও জোবায়ের (২০) তখন স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছিলেন, হবিগঞ্জ থেকে আনার সময় দালাল সাগর বিশ্বাস বলেছিলেন, জাহাজে করে মালয়েশিয়ায় পাঠাবেন। এখানে কোনো টাকা দিতে হবে না। মালয়েশিয়ায় চাকরি করে খরচের সামান্য টাকা পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু কক্সবাজারে এনে তাঁদের আরেক দালালের হাতে তুলে দিয়ে সাগর বিশ্বাস মাথাপিছু ১৫ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিলেন। কেন নিলেন ধরা পড়ে বুঝতে পারছি।
থানার হাজতে সাগর বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে টাকা ছাড়াই লোকজনকে কক্সবাজার নিয়ে আসার শত শত দালাল রয়েছেন। কক্সবাজারের দালালের হাতে লোকজন তুলে দিলেই মাথাপিছু পাঁচ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। তাই মানব পাচার এখন লাভজনক ব্যবসা। পরে থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে মাথাপিছু দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা করে আদায় করা হয়।
সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট শহরের নাজিরাটেক উপকূলে শতাধিক যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার বিধ্বস্ত হয়। এতে নরসিংদীর আলম শেখ (৩৫) নামের এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। ওই ট্রলারের উদ্ধার হওয়া যাত্রী ও নরসিংদীর রায়পুর উপজেলার আদিয়াবাসকান্দা গ্রামের জহিরুল হকের ছেলে মোহাম্মদ শাহিন (৩৫) প্রথম আলোকে বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মালয়েশিয়া যাত্রাকালে উত্তাল ঢেউয়ের ধাক্কায় ট্রলারটি বিধ্বস্ত হয়। এ সময় তিনি একটি বড় গ্যালন ধরে ভাসতে ভাসতে উপকূলে ফিরে আসেন।
কক্সবাজারে সদ্য যোগ দেওয়া পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, মানব পাচার বন্ধে পুলিশকে সক্রিয় রাখা হয়েছে। পাশাপাশি উপকূলের মানুষকে সচেতন করতে ইতিমধ্যে পুলিশ উখিয়া, টেকনাফ ও সদর উপজেলায় শোভাযাত্রা-সমাবেশ করেছে।
৬০টি স্থান দিয়ে মানব পাচার: কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছটা, ফিশারিঘাট, নাজিরাটেক, সমিতিপাড়া, মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, কুতুবজোম, ধলঘাটা, উখিয়ার সোনারপাড়া, রেজুরখাল, ইনানী, ছেপটখালী, মনখালী, টেকনাফের বাহারছড়া, সাবরাং, শাহপরীরদ্বীপ, ঘোলারপাড়া, মাঝরপাড়া, পশ্চিমপাড়া, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, হাদুরছড়া, জাহাজপুরা, কচ্ছপিয়া, শামলাপুর, সদরের ঈদগাঁও, খুরুশকুল, চৌফলদণ্ডী, পিএমখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, পটিয়াসহ অন্তত ৬০টি স্থান (পয়েন্ট) দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সমুদ্রে নেমে বিপদে পড়ছেন। কিন্তু এসব স্থানে সার্বক্ষণিক পুলিশের নজরদারি নেই।
৬০টি স্থান দিয়ে মানব পাচার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, ৬০ কেন, ১২০ কিলোমিটারের পুরো সাগর উপকূলটাই আদম পাচারের নিরাপদ পয়েন্ট। তবে কোনো পয়েন্টেই পুলিশের সার্বক্ষণিক টহল থাকে না। মানব পাচারের খবর পেলেই নিকটস্থ ফাঁড়ি থেকে গিয়ে পুলিশ অভিযান চালায়।
তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, গত ১১ জুন সেন্ট মার্টিনের অদূরে বঙ্গোপসাগরে দালালদের নিযুক্ত বিদেশি সন্ত্রাসীর গুলিতে পাঁচজন বাংলাদেশি মালয়েশিয়া যাত্রী নিহত হন। তাঁরা হলেন যশোরের সেলিম (৩১), রুবেল (৩৫), বগুড়ার সাইফুল ইসলাম (৪০), সিরাজগঞ্জের মনির (৩০) ও নারায়ণগঞ্জের এবাদুল (২০)। গুলিবিদ্ধ হন আরও ৬৩ যাত্রী। কোস্টগার্ডের সদস্যরা সাগর থেকে হতাহত যাত্রীদের উদ্ধার করে টেকনাফ নিয়ে আসেন। ৩১৮ যাত্রী নিয়ে ওই ট্রলারটি টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা দেয়।
নিখোঁজ, হাহাকার: ২০১২ সালের ৭ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে টেকনাফ উপকূলে ১১০ জন যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার উল্টে যায়। পরদিন সকালে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও বিজিবির সদস্যরা সমুদ্রে তল্লাশি চালিয়ে ২৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করলেও নিখোঁজ থাকেন আরও ৮২ জন। এঁরা সবাই টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের হারিয়াখালী, ডেইলপাড়া, পুরানপাড়া, ঝিনাপাড়া, গুচ্ছগ্রামসহ আশপাশের ১৩টি গ্রামের মানুষ।
গত ৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে হারিয়াখালী ও খুরেরমুখ গ্রাম পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, ঘরে ঘরে হাহাকার। নিখোঁজ ছেলের জন্য অনেক মা কান্নাকাটি করছেন। হারিয়াখালী গ্রামের বৃদ্ধ মো. হোসেন জানান, ওই ট্রলারডুবির ঘটনায় তাঁর দুই ছেলে জাফর আলম (৩৫) ও নুরুল আলম (২৭) নিখোঁজ রয়েছেন। আরও নিখোঁজ রয়েছেন হারিয়াখালী গ্রামের আবদুর রশিদের ছেলে ও নায়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আবদুল্লাহ (১৩), মো. হাবিবের ছেলে ইসমাঈল (২০), আবদুল মালেকের ছেলে মুহিব উল্লাহ (২২), কালু মিয়ার ছেলে মো. ছৈয়দ (২১), করিম উল্লাহর ছেলে সলিম উল্লাহ (২২), গুরা মিয়ার ছেলে কেফায়েত উল্লাহসহ অনেকে।
স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় আবদুর রশিদ বলেন, দালালের কারণে ঘরে ঘরে এখন কান্নাকাটি আর আহাজারি শোনা যায়।
বন্দিজীবন: উখিয়ার ছোয়াংখালী গ্রামের আলতাজ মিয়া গত ৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোকে জানান, দালালের খপ্পরে পড়ে তাঁর ছেলে নুরুল কবির (২৮) এখন থাইল্যান্ডের কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি এক দালাল মালয়েশিয়ায় ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে তাঁকে ট্রলারে তুলে দেন। কয়েক দিন পর থাইল্যান্ড সীমান্তে গিয়ে নৌবাহিনীর হাতে তাঁর ছেলেসহ শতাধিক যাত্রী ধরা পড়েন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে থাইল্যান্ড সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেও ছেলেকে ফেরত আনা যাচ্ছে না।
টেকনাফ ৪২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আবুজার আল জাহিদ জানান, বর্তমানে মিয়ানমারের তিনটি কারাগারে ২৮১ জন, থাইল্যান্ডের দুটি কারাগারে ৩১৬ জন বাংলাদেশি বন্দী রয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গত ১৯ মার্চ মিয়ানমার কারাগার থেকে ২৬ বাংলাদেশিকে টেকনাফে ফেরত আনা হয়েছে। অন্যদেরও ফেরত আনার চেষ্টা চলছে।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত আট মাসে পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা শুধু টেকনাফ উপকূল থেকেই ৫৩৩ যাত্রীকে আটক করেন। এ ব্যাপারে চার শতাধিক দালালের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মামলা করা হয়েছে ১২২টি। এখন দালালদের ধরে মানব পাচার বন্ধের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।