শ্রমমান উন্নতির জন্য সময় পেল বাংলাদেশ

রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা ও কারখানার কর্মপরিবেশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে পরিস্থিতির আরও উন্নতি দেখতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তাই এসব বিষয়ে আগামী বছর পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা হবে।
গতকাল সোমবার ব্রাসেলসে ‘সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট’-এর পর্যালোচনা সভায় এ অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ ও শ্রমমানউন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বা সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট নামে এ উদ্যোগটি নেওয়া হয়। পর্যালোচনা সভায় তৈরি পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ ও শ্রমমান উন্নয়নে বাংলাদেশকে বাড়তি সময় দেওয়ারও মত দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার ইইউ। গত অর্থবছর পোশাক খাত থেকে মোট দুই হাজার ৪৪৯ কোটি ডলার রপ্তানি আয় হয়। এর মধ্যে শুধু ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকেই এসেছে এক হাজার ৪৭৪ কোটি ডলার, যা এ খাতের মোট রপ্তানি আয়ের ৬০ দশমিক ২১ শতাংশ।
ব্রাসেলস থেকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের কর্মকর্তারা এ প্রতিবেদককে জানান, দিনব্যাপী ওই পর্যালোচনা বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে অগ্রগতি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে কমপ্যাক্টের পর্যালোচনা সভায় ১২ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল অংশ নেয়।
সভায় ইউরোপীয় কমিশনের শ্রম ও সামাজিক বিষয়ক কমিশনার লেজলো অ্যানডর বলেন, শ্রম আইন সংশোধন, নতুন ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন এবং শ্রমিক, অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কারখানা পরিদর্শন ইত্যাদি খুবই উৎসাহব্যঞ্জক পদক্ষেপ। তবে আরও অগ্রগতি অর্জনে উদ্যোগ নিতে হবে। এসব উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে সংগঠিত হওয়ার অধিকার সুরক্ষা, ভয়-ভীতি ও বৈষম্য থেকে শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়নকে সুরক্ষা, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকাসহ (ইপিজেড) সব শ্রমিকের সম-অধিকার নিশ্চিত করা।
এদিকে ব্রাসেলস থেকে মুঠোফোনে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পোশাক খাতের অগ্রগতি নিয়ে সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে ইইউ কমপ্যাক্টে আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে চায় তারা। এর মধ্যে আছে ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন চালু। আমি তাদের বলেছি, এটা করতে গেলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা থাকবে না। কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে এবং অসন্তোষ তৈরি হবে।’
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘পোশাক খাতে ভালো পরিবেশ বিরাজমান বলে বৈঠকে জানিয়েছি। ইপিজেডে ৪০০ কারখানার মধ্যে ২১৭টিতে ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউডব্লিউএ) আছে। এ কারখানাগুলোর শ্রমিকেরা কেউ ১০ হাজার টাকার নিচে মজুরি পান না।’
ইইউর ওয়েবসাইটে লেজলো অ্যানডরের বক্তব্যে বলা হয়েছে, সংশোধিত শ্রম আইনের কার্যকর বাস্তবায়নে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশকে। বিশেষ করে শ্রম সংগঠনের স্বাধীনতায় সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা, ভীতি ও বৈষম্য থেকে শ্রমিক এবং ট্রেড ইউনিয়নকে সুরক্ষা, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাসহ (ইপিজেড) সব শ্রমিকের সম-অধিকার নিশ্চিত করা। এ ছাড়া অতিরিক্ত পরিদর্শক নিয়োগ এবং পরিদর্শনকাজ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে। একই সঙ্গে রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্ত পোশাককর্মীদের পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
লেজলো অ্যানডর বলেন, ‘আমরা ধারাবাহিকভাবে কমপ্যাক্টের বাস্তবায়ন ও ফলাফল পর্যবেক্ষণ করব। আগামী বছর আবারও পর্যালোচনা বৈঠক হবে। কমপ্যাক্টের সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে কমিশন বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের অধিকার ও কারখানার কর্মপরিবেশের বাস্তবিক অগ্রগতির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসে ইইউ। বিশেষ করে গত বছরের জুনে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা (জিএসপি) বাতিল করার পর এক বিবৃতি দিয়েছিল ইইউ। বিবৃতিতে বলা হয়, ইইউ মৌলিক মানবাধিকার সমুন্নত রাখায় বদ্ধপরিকর। এ ক্ষেত্রে শ্রমমানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইইউ এ জন্য আইএলওকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছে এবং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ইইউ সব সময়ই পাশে থাকতে চায়। তবে শ্রমমান ও কর্মপরিবেশের উন্নতি অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে এক বছর সময় দিতে চায় ইইউ।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ৮ জুলাই জেনেভাতে সাসটেইনিবিলিটি কমপ্যাক্ট নামের উদ্যোগটি গৃহীত হয়। এতে শ্রম আইন সংশোধন, ২০০ শ্রম পরিদর্শক নিয়োগ, ইপিজেড আইন সংশোধন, সাধারণের প্রবেশযোগ্য তথ্যভান্ডার তৈরি, রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা যাচাই-বাছাই, ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন, শ্রমিকদের সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ তৈরি ও শ্রমিকদের কল্যাণের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।