প্রধানমন্ত্রী পরীক্ষার বিপক্ষে, তবে ভর্তি আগের নিয়মেই

দেশের উচ্চশিক্ষায় ভর্তির বিদ্যমান ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ, ব্যয়বহুল ও কোচিংনির্ভর হলেও এ থেকে এ বছর মুক্তি পাচ্ছেন না ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা। এ দুর্ভোগ কমানোর জন্য কয়েক বছর ধরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুচ্ছ ভিত্তিতে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হলেও তা কার্যকর হয়নি। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জানিয়েছেন, এবার গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়।
গত শনিবার ফল প্রকাশের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উচ্চশিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে মত দিয়ে বলেন, ‘পরীক্ষা তো একবার দিলই। রেজাল্টের ওপর যে যেখানে চায়, সেখানে ভর্তি হবে। এত পরীক্ষার দরকার কী?’ তবে তিনি বলেন, এটি পুরোপুরি তাঁর ব্যক্তিগত মত।
ভর্তি পরীক্ষার পরিবর্তে এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির বিষয়টি কয়েক বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। এর সপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত মতামতের পর তা আরও জোরালো হয়ে উঠেছে।
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং কয়েকজন উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, শিক্ষার্থীদের এবারও দুর্ভোগ নিয়ে ভর্তিযুদ্ধে লড়তে হবে। এ ছাড়া ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন কম থাকায় ভর্তির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হবে তাঁদের।
ভর্তির বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান ভর্তি-প্রক্রিয়ায় কিছু সমস্যা আছে। এ জন্য তাঁরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন এটাকে কীভাবে আরও সহজ করা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা সমন্বিত বা গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হলেও সময় কম থাকায় এ বছর ওই পদ্ধতি চালু হচ্ছে না। এবার আগের মতোই পরীক্ষা হবে। তবে ভবিষ্যতে এ পদ্ধতি চালু করা সম্ভব হবে বলে জানান মন্ত্রী।
ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রথম বর্ষে ভর্তির প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল। বর্তমান পদ্ধতিতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে ছয় থেকে ১০টি ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। আসন কম থাকায় শিক্ষার্থীদের দেশের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছুটতে হয়। একই সময়ে ভর্তি পরীক্ষা হওয়ায় কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারেন না ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্ররা। অন্যদিকে পরীক্ষার পর দীর্ঘ সময় শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারের শরণাপন্ন হন। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েন তাঁদের অভিভাবকেরা।
অভিভাবকেরা বলছেন, ১২ বছর পড়াশোনার পর শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। নকল কমে যাওয়ায় এ দুই পরীক্ষার ফল এখন গ্রহণযোগ্য।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মতে, এসএসসি ও এইচএসসি ফলাফলের ভিত্তিতেই উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হওয়া উচিত। এতে কোচিং বাণিজ্য কমবে, অভিভাবকদের অর্থ সাশ্রয় হবে এবং ভর্তির নামে শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের যে হয়রানি হতে হয়, সেটাও বন্ধ হবে।’
ইউজিসির সূত্রমতে, উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের এক গবেষণায়ও বর্তমান পদ্ধতিতে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা নানাভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য সমন্বিত বা গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তির সুপারিশ করা হয় এ গবেষণায়। গুচ্ছ ভিত্তিতে মেডিকেলের মতো একই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একেকটি গুচ্ছ করে একটি পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়—এ তিনটি গুচ্ছ করে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, উচ্চশিক্ষায় ভর্তি নিয়ে ফল প্রকাশের আগে গত ৭ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপাচার্যদের নিয়ে সভা করেন শিক্ষামন্ত্রী। ওই সভায় বেশির ভাগ উপাচার্য সমন্বিত বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হন। তবে এ বছর এটা চালু করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন তাঁরা।
ওই সভায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ভর্তি পদ্ধতির সংস্কার করার মাধ্যমে কোচিং বাণিজ্য কীভাবে বন্ধ করা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।
ভালো প্রতিষ্ঠানে হবে তীব্র প্রতিযোগিতা: শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি জানায়, সার্বিকভাবে এবার উচ্চশিক্ষায় আসন নিয়ে কোনো সংকট হবে না। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল কলেজগুলোতে আসন কম থাকায় ভালো ফল করেও ভর্তির জন্য তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে শিক্ষার্থীদের।
বিজ্ঞানে জিপিএ-৫ পেয়েও প্রত্যাশিত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবেন না অনেক শিক্ষার্থী। এবার বিজ্ঞানে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২৭ হাজার ৮৭৩ জন শিক্ষার্থী। অথচ বিজ্ঞানের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর প্রথম পছন্দ মেডিকেল ও বুয়েটে ভর্তি হওয়া। অথচ বুয়েটে প্রথম বর্ষে ভর্তির আসন আছে প্রায় এক হাজার ও সরকারি মেডিকেল কলেজে আছে প্রায় আড়াই হাজার। এখন পর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত, তাতে মেডিকেল কলেজে আগের মতোই ভর্তি পরীক্ষা হবে।
মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভালো ফল করা শিক্ষার্থীরাও প্রত্যাশার জায়গায় ভর্তি হতে পারবেন না। এবার আট বোর্ডের এইচএসসিতে মানবিকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন পাঁচ হাজার ৭২৪ জন শিক্ষার্থী। আর ব্যবসায় শিক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৩ হাজার ১৩৯ জন। সাধারণ বোর্ডের পাশাপাশি মাদ্রাসা ও কারিগরি মিলিয়ে সব বোর্ডে মোট জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫৮ হাজার ১৯৭ জন। তাঁরা সবাই উচ্চশিক্ষায়, বিশেষ করে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির চেষ্টা করবেন। কিন্তু আসনস্বল্পতায় তাঁদের লড়তে হবে কঠিন লড়াইয়ে।
তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ও ডিগ্রি কোর্স এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে মোট আসনের কোনো সংকট হবে না। ডিগ্রি কোর্স এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পেলেই ভর্তি করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন ‘এইচএসসির পর সব সময়ই ভর্তির আসনের প্রশ্নটি ওঠে। আমি বলব, সার্বিকভাবে আসনের কোনো সংকট হবে না। তবে ভালো প্রতিষ্ঠানে আসন কম। সারা দুনিয়াতেও তাই। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তো সবাই পড়তে পারে না। সুতরাং ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়া প্রতিযোগিতামূলক হবে—এটাই স্বাভাবিক।’