আপিল করেছেন গোলাম আযম

গোলাম আযম
গোলাম আযম

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ৯০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম। আজ সোমবার দুপুরে গোলাম আযমের আইনজীবীরা আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় খালাস চেয়ে আপিলটি দায়ের করেন।রায় ঘোষণার ২১ দিনের মাথায় আপিল করলেন গোলাম আযম।
পরে এক ব্রিফিংয়ে আইনজীবী তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আপিলে মোট ১০৯টি যুক্তি দেওয়া হয়েছে।মূল আপিলটি ৯৫ পৃষ্ঠার।গোলাম আযমের ৯০ বছরের কারাদণ্ডের আদেশের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে আপিলটি করা হয়েছে।সাজা ঘোষণার পক্ষে ঘটনা ও আইনগত কোনো যুক্তি নেই।
তাজুল ইসলাম বলেন, রায়ে বলা হয়েছে টিক্কা খানের সঙ্গে গোলাম আযম দেখা করেছেন ও বক্তব্য দিয়েছেন।এ কারণে তিনি জড়িত।কিন্তু দেখা করে কী করেছেন, সে বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো বিবরণ দেয়নি।তাই সাজা হতে পারে না।বক্তব্য দেওয়ার কারণে অপরাধের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হয় না।
মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত ১৫ জুলাই গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তাঁর অপরাধ মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য হলেও বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ, দালিলিক নথি ও যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে আসামির বিরুদ্ধে গঠন করা পাঁচটি অভিযোগের সবগুলো রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে।

এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ছয়টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে একাত্তরের ৪ ও ৬ এপ্রিল অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক, ১৯ জুন ও ১ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক। এই ষড়যন্ত্রের দায়ে তাঁকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনার অভিযোগে তাঁকে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনার অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ৪ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক, যার ধারাবাহিকতায় ৯ এপ্রিল ঢাকায় ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন এবং ৪ মে শান্তি কমিটির সভা।

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গঠিত তৃতীয় অভিযোগ উসকানি। এই অভিযোগের দায়ে তাঁকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে উসকানির ২৮টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে ৭ এপ্রিল স্বাধীনতাকামী মানুষকে ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী’ উল্লেখ করে গোলাম আযমের যুক্ত বিবৃতি; ১৭ মে ঢাকায় এক সভায় স্বাধীনতা আন্দোলনকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ’ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ উল্লেখ করে বক্তব্য; ১৬ জুলাই রাজশাহী, ১৮ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৪ আগস্ট খুলনা, ৭ আগস্ট কুষ্টিয়াসহ অনেক এলাকায় বিভিন্ন সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রভৃতি।

মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা বা সম্পৃক্ততার ২৩টি ঘটনা দিয়ে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে চতুর্থ অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে ১৮ জুন লাহোর বিমানবন্দরে বক্তব্য, ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক এবং ২০ জুন লাহোরে সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য। এই অভিযোগে তাঁকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

গোলাম আযমের বিরুদ্ধে হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ একটি। এ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২১ নভেম্বর তাঁর লেখা চিঠির নির্দেশ অনুসারে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সিরু মিয়া, তাঁর ছেলে আনোয়ার কামালসহ ৩৮ জনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গুলি করে হত্যা করে রাজাকার ও আলবদররা। এই অভিযোগের দায়ে গোলাম আযমকে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

শাস্তিদানবিষয়ক সিদ্ধান্তে ট্রাইব্যুনাল বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান রক্ষার নামে গোলাম আযম ছিলেন কার্যত একজন ঊর্ধ্বতন নেতা এবং শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি আধা সামরিক বাহিনীর স্থপতি। আর পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরোচিত বাঙালি নিধনে সাহায্য করেছে এসব আধা সামরিক বাহিনী। এ জন্য রাষ্ট্রপক্ষ গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছে।

রায়ে বলা হয়, মামলার ঘটনা, আইনগত অবস্থান এবং অপরাধের গভীরতা ও গুরুত্ব বিবেচনায় ট্রাইব্যুনাল সর্বসম্মতভাবে মনে করেন, গোলাম আযম সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য। একই সঙ্গে এটাও বিবেচনা করতে হবে, তাঁর বয়স ৯১ বছর। গত বছরের ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল তাঁকে কারাগারে পাঠান। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ বিএসএমএমইউ হাসপাতালের কারাকক্ষে পাঠিয়ে দেন। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে সেদিন থেকে তিনি সেখানেই চিকিত্সাধীন আছেন। এসব বিষয় বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল সর্বসম্মতভাবে মনে করেন, গোলাম আযমকে কিছুটা প্রশমিত শাস্তি দেওয়া হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।

চূড়ান্ত আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসামি গোলাম আযমকে প্রথম (ষড়যন্ত্র) ও দ্বিতীয় (পরিকল্পনা) অভিযোগে ১০ বছর করে ২০ বছর কারাদণ্ড, তৃতীয় (উসকানি) অভিযোগে ২০ বছর কারাদণ্ড, চতুর্থ (সহযোগিতা) অভিযোগে ২০ বছর কারাদণ্ড এবং পঞ্চম (সিরু মিয়া হত্যাকাণ্ড) অভিযোগে ৩০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হলো। কারাদণ্ডের প্রতিটি শাস্তি ধারাবাহিকভাবে একটির পর একটি বা মৃত্যু পর্যন্ত চলবে।