নির্বাচন প্রতিহত করতে না পারার ব্যর্থতা স্বীকার খালেদা জিয়ার

আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে দলীয় কর্মীদের আহ্বান জানাচ্ছেন খালেদা জিয়া। নীলফামারী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় তিনি এ আহ্বান জানান। ছবি: প্রথম আলো
আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে দলীয় কর্মীদের আহ্বান জানাচ্ছেন খালেদা জিয়া। নীলফামারী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় তিনি এ আহ্বান জানান। ছবি: প্রথম আলো

গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে না পারার জন্য নিজের ও ঢাকার নেতাদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘আমি দোষ দেব আমাদের। আমরা পারিনি। আমি ধন্যবাদ দেব আপনাদের। আপনারা সারা দেশে কঠোর আন্দোলন করেছেন।’
আজ বৃহস্পতিবার নীলফামারী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন। দশম সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থতার কথা বললেও আগামী দিনে সরকার পতন আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট সফল হবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সেবার ঢাকা আন্দোলন করতে পারেনি। কিন্তু এবার ইনশাল্লাহ পারবে। ঢাকাও আন্দোলন করবে। সারা দেশ আন্দোলন করবে।’

প্রায় এক ঘণ্টার বক্তব্যে খালেদা জিয়া সরকারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার বিভাগের সমালোচনা করেন। আওয়ামী লীগের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অর্থনীতি খারাপ অবস্থায় রয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। জাতীয় পার্টির সমালোচনা করে বলেন, ‘লাঙ্গল আর লাঙ্গল নেই। লাঙ্গল নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে।’

ভবিষ্যতে ২০-দলীয় জোট ক্ষমতায় এলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, নির্দলীয় প্রশাসন ও বিচার বিভাগ গড়া, গণমাধ্যমকে নিরপেক্ষ করা যেন সঠিকভাবে কাজ করতে পারে, দুর্নীতি দমন কমিশনে সৎ, শক্ত লোককে বসানোর কথা বলেন খালেদা জিয়া।

খালেদা জিয়া যখন জনসভাস্থলে এসে পৌঁছান, তখন বিশাল মাঠ প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ। সমাবেশ মঞ্চের কাছে জামায়াতের নেতা–কর্মীদের প্রাধান্য ছিল বেশি। তবে এবার ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরাও কিছু অংশ দখলে রাখেন।

হাসিনাকে বিদায় করে তবেই ঘরে ফেরা
গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ‘প্রতিহত’ করার ডাক দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তবে তাঁর সেই আহ্বান শেষ পর্যন্ত সফল করতে পারেনি বিএনপি ও জোটের শরিকেরা। কবে নাগাদ সরকার পতনের সেই আন্দোলন শুরু হবে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা দেননি সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তবে জনগণকে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘যখনই সময় আসবে, তখনই আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। এবার আন্দোলন শুরু হলে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে বিদায় করে তবেই ঘরে ফেরা হবে।’ খালেদা জিয়া বলেন, ভালো কথায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন না দিলে কঠোর আন্দোলন করতে হবে। যাকে বলে সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হবে।

নীলফামারী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের জনসভায় আগত নেতা-কর্মীরা। ছবি: প্রথম আলো
নীলফামারী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের জনসভায় আগত নেতা-কর্মীরা। ছবি: প্রথম আলো

সরকারকে কেউ স্বীকৃতি দেয়নি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবির দিকে ইঙ্গিত করে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, সরকারকে কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। শুধু বিদেশে গিয়ে ছবি তুললেই, ফটোসেশন করলেই স্বীকৃতি পাওয়া যায় না। দেশে গণতন্ত্র না থাকলে কেউ স্বীকৃতি দেবে না।
সরকারের মামলায় ফতুর হচ্ছেন নেতা-কর্মীরা
খালেদা জিয়া বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে দলীয় নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা ছিল। সেগুলো কীভাবে শেষ হলো। আর বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো কেন শেষ হচ্ছে না। তিনি বলেন, বিরোধী দলের নেতারা মামলার হাজিরা দিতে দিতে ফতুর হয়ে যাচ্ছে।
র‌্যাব টাকার বিনিময়ে খুন করছে
খালেদা জিয়া বলেন, সরকার মিথ্যার ওপর ভর দিয়ে টিকে আছে। কিন্তু এভাবে টিকে থাকা যাবে না। চুরি করে ক্ষমতায় থাকা যায় না। ভোট দেন, ভোটে জিতলে ক্ষমতায় থাকবেন। তিনি বলেন, সরকার ব্যার ও পুলিশকে রক্ষী বাহিনী বানাচ্ছে। র‌্যাব টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করছে। র‌্যাবকে বাতিল করতে হবে। তিনি বলেন, রক্ষীবাহিনী ৩০ হাজার মানুষ হত্যা করেছে আর এরা হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করছে।

জামায়াতের ধমকে চুপ বিএনপি
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন টেলিভিশনগুলো সরাসরি দেখানো হবে বলে টেলিভিশন সাংবাদিকদের অনুরোধে বিএনপির চেয়ারপারসনের জনসভার সময় কিছুটা এগিয়ে আনা হয়। তাঁর সাড়ে তিনটায় জনসভাস্থলে আসার কথা থাকলেও তিনি সোয়া তিনটায় পৌঁছান। ৪টা ১০ মিনিটে বক্তব্য শুরু করে শেষ করেন ৫টায়। সমাবেশ নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর তোপের মুখে পড়েন বিএনপির নেতারা। মঞ্চে জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তিনি যখন তাঁর বক্তব্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে তাঁর দলের নেতাদের মুক্তি চাচ্ছিলেন, তখন পেছন থেকে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শামসুজ্জামান ও কয়েকজন নেতা তাঁকে বক্তব্য এক মিনিটে শেষ করতে বলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মুজিবুর রহমান বলেন, ‘জামায়াত একটা দল। তাদের এক মিনিটে হবে না।’ এতে চুপসে যান বিএনপির নেতারা। এরপর জামায়াতের নেতা আট মিনিটের মতো বক্তব্য দেন।
সমাবেশ স্থলে জামায়াত ও তাঁদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষÿকরা গেছে। তারা পোস্টার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে সমাবেশস্থলের সামনের বেশির ভাগ জায়গা দখল করে রাখেন।

ছাত্রদলের নতুন কমিটির পরিচিতি
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নতুন কমিটির সভাপতি রাজিব আহসান, সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান ও সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারকে জনসভায় পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় ছাত্রদলের পদবঞ্চিত পক্ষের নেতারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট এই জনসভার আয়োজন করে। এরপর ৩০ অক্টোবর নাটোর, ৬ অথবা ৭ নভেম্বর কুমিল্লা এবং ১২ নভেম্বর কিশোরগঞ্জে জনসভা অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে একই দাবিতে আরও ছয়টি জেলায় জনসভা করেন খালেদা জিয়া। ৫ জানুয়ারির পর কয়েকবার আন্দোলনের ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত ২০-দল জনসভার মধ্যেই তাদের কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রেখেছে।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আনিসুল আরেফিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জনসভায় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) অলি আহমদ, খেলাফত মজলিসের সভাপতি মো. ইসহাক, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামী, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সভাপতি শফিউল আলম, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, জমিরউদ্দিন সরকার, ঢাকা মহানগরের বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস, জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক মীর সেলিম ফারুক, জহুরুল আলম, বিএনপিদলীয় সাবেক সাংসদ রিনা পারভীন প্রমুখ বক্তব্য দেন।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে খালেদা জিয়া বগুড়া সার্কিট হাউস থেকে নীলফামারীর উদ্দেশে রওনা দেন। গতকাল বুধবার বিকেলে জনসভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে বগুড়ায় আসেন। আজ রাতেই খালেদা জিয়া ঢাকার উদ্দেশে নীলফামারী ছাড়েন। জনসভা শেষে খালেদা জিয়া নীলফামারী সার্কিট হাউসে যান। সেখানে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতের আন্দোলনে নিহত চারজনের প্রত্যেকের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেন তিনি।