৭ আসামিকে অব্যাহতি

দুদক কার্যালয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান (ডানে) ও কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন l ছবি: প্রথম আলো
দুদক কার্যালয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান (ডানে) ও কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন l ছবি: প্রথম আলো

পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি খুঁজে পায়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাই সন্দেহভাজন দুই সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ পদ্মা সেতু দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের মামলার সাত আসামিকেই অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। 
গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে প্রথমে মামলা করা হয়। তবে মামলা-পরবর্তী তদন্তে আমরা ষড়যন্ত্রেরও কোনো প্রমাণ পাইনি।’
কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দিতে ‘ঘুষ লেনদেন ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সাবেক সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া, সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দরপত্র মূল্যায়নে গঠিত কমিটির সদস্যসচিব কাজী ফেরদাউস, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, এসএনসি-লাভালিনের সে সময়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল ও আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং তাঁদের স্থানীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক মো. মোস্তফার বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা দায়ের করে দুদক। মামলার এজাহারে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা না করা হলেও তাঁদের ‘তদন্তের আওতায়’ রাখা হয়। এখন তাঁরা সবাই অব্যাহতি পেলেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে নাটক এখনো শেষ হয়নি। এ বিষয়ে জনগণের প্রচুর কৌতূহল ও প্রশ্ন রয়েছে। দুদকের সিদ্ধান্তের ওপরে আস্থা রাখতে চাই, কিন্তু বিদেশি আদালতের সিদ্ধান্তে আবার নতুন করে এ নাটকের নতুন অধ্যায় শুরু হলেও হতে পারে। একই সঙ্গে নাইকোর মতো পদ্মার ক্ষেত্রেও অভিযুক্তরা ছাড় পেয়ে যাবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। যেমন, নাইকো মামলায় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের অপরাধ কানাডা আদালতে প্রমাণিত হলে তাদের জরিমানা গুনতে হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশ দেশীয় অভিযুক্তদের ছেড়ে দেয়।
২০ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে দুদক চেয়ারম্যান গতকাল বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক দাবি করেছিল, পরামর্শক নিয়োগেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। গণমাধ্যমেও এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়। পরে আমরা অনুসন্ধান শেষে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এ বিষয়ে একটি মামলা দায়ের করি। তবে মামলা-পরবর্তী তদন্তে আমরা দুর্নীতি বা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগের কোনো সত্যতা পাইনি।’
দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক টিমের সঙ্গে আমাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তারা আমাদের সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেনি, যার ভিত্তিতে আমরা তদন্ত চালিয়ে যেতে পারি। এ ছাড়া তদন্ত সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার মতো কোনো তথ্যও ছিল না।’
এর আগে কমিশনে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে মামলাটি নথিভুক্ত করে এর কার্যক্রম বন্ধ করার সুপারিশ করেন প্রধান তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মামলার তদন্তে পর্যাপ্ত তথ্য ও সাক্ষী না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে মামলাটিকে নথিভুক্ত করার সুপারিশ করা হচ্ছে। কারণ, দেড় বছরের বেশি সময়ের তদন্তে মামলাটিকে এগিয়ে নেওয়ার মতো ন্যূনতম তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে কানাডা থেকে রমেশ শাহর কথিত ডায়েরি সংগ্রহ করা সম্ভব হলে, নতুন করে অনুসন্ধান করা যেতে পারে। এই ডায়েরিতে কাজ পেতে কাকে কত অর্থ দিতে হবে, তার একটি তালিকা ছিল।
তবে রমেশ শাহর ডায়েরি বলে কিছুই নেই দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করেছিল, কানাডার এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ শাহর ডায়েরিতে ঘুষের তালিকা ছিল। কিন্তু ডায়েরির কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। কানাডার আদালতে বলা হয়েছে নোটপ্যাডের কথা। নোটপ্যাড আর ডায়েরির মধ্যে পার্থক্য অনেক। কাজেই রমেশের ডায়েরি বলে কিছু নেই।’
প্রশ্নের জবাবে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘যেকোনো প্রাথমিক অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা করা হয়। আর সে সময়ে মামলা করার পেছনে বিশ্বব্যাংক থেকে কিছু তথ্য ছিল। মামলার পরে বিশ্বব্যাংক এবং কানাডা পুলিশ বিভাগ ও কানাডা আদালত থেকে আরও তথ্য পাওয়ার আশা ছিল। কিন্তু পরে তারা তথ্য সরবরাহ করেনি।
একই বিষয়ে কানাডার আদালতে মামলা প্রক্রিয়াধীন কিন্তু বাংলাদেশে মামলা নথিভুক্ত হয়ে গেল, কারণ কী?—এ প্রশ্নের জবাবে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘কানাডার মামলাটি হচ্ছে, ‘এসএনসি-লাভালিনের করা স্পিড মানির তহবিল, যা দিয়ে তৃতীয় বিশ্বে কাজ বাগানো হয়। আর আমাদেরটি হচ্ছে দুর্নীতির জন্য ষড়যন্ত্র করা নিয়ে। দুটি ভিন্ন বিষয়। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’ বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ কি উদ্দেশ্যমূলক ছিল?—উত্তরে মো সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘টু বি ফ্রাঙ্ক, সামথিং ওয়াজ দেয়ার’।
অবশ্য দুদকের এই কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে মন্তব্য করেন দুর্নীতি প্রতিরোধ বিষয়ে কাজ করা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, মামলার আগে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ-প্রমাণসহ উপস্থাপন করা হলো। জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত এবং এর মধ্যে কিছু অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা হলো। আবার সেই দুদকই এখন অভিযুক্তদের দায়মুক্তি দিচ্ছে। নিজেদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে নিজেরাই সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে দুদক।
দুদকের এ সিদ্ধান্ত সঠিক হলে সরকারকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জবাবদিহি চাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন টিআইবি প্রধান ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে নাজেহাল করার কৈফিয়ত চাইতেই পারে সরকার। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাঁদের মর্যাদাহানির বিষয়টিও বিবেচনা করার পরামর্শ দেন তিনি।
দেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতু নির্মাণে ২৯১ কোটি ডলারের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল। তবে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তারা অর্থায়ন স্থগিত এবং পরে তা বাতিলও করে। একপর্যায়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় বিশ্বব্যাংক ফিরলেও দুদকের তদন্তের ফলাফলে তারা অসস্তুষ্টি জানায়। এরপর সরকার দাতাদের কাছ থেকে অর্থ নেবে না বলে নিজেরাই জানিয়ে দেয়। এরপর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার।