১২৪ কেজি সোনা পাচারে জড়িত বিমানের ১০ কর্মী

সোনা
সোনা

১৫ মাস আগে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটক ১২৪ কেজি সোনা আনার ঘটনায় ১৪ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এঁদের মধ্যে ১০ জন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কর্মী। বাকিদের মধ্যে দুজন বাংলাদেশি, একজন ভারতীয় ও একজন নেপালের নাগরিক রয়েছেন। 
এ-সংক্রান্ত ৫২৩ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন গতকাল রোববার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে জমা পড়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিহ্নিত এই ১৪ জন হচ্ছেন এই সোনা পাচারের কান। মাথা এখনো পাওয়া যায়নি।’ তাঁর মতে, ফৌজদারি মামলা করে যথাযথ তদন্ত করলে মাথাও শনাক্ত করা সম্ভব।
গত বছরের ২৪ জুলাই দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজের (এয়ারবাস) কার্গো হোল থেকে ১২৪ কেজি ওজনের এক হাজার ৬৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। শুল্ক বিভাগের হিসাবে, যার মূল্য প্রায় ৫৪ কোটি টাকা। এযাবৎ ধরা পড়া সোনার চালানের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় চালান। অবশ্য এরপর গত ১৫ মাসে আরও অন্তত অর্ধশত সোনার চালান ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে ধরা পড়েছে।
এ ঘটনায় শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খানকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এনবিআর। কমিটিতে শুল্ক বিভাগের বাইরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের দুজন কর্মকর্তাও আছেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে এই সোনা পাচারে জড়িত হিসেবে ১০ বিমানকর্মীর নাম এসেছে। তাঁরা হলেন উড়োজাহাজ মেকানিক মাসুদুর রহমান, মেকানিক অ্যাসিস্ট্যান্ট আনিস উদ্দিন ভূঁইয়া, জুনিয়র ইন্সপেকশন অফিসার শাহজাহান সিরাজ, জুনিয়র সিকিউরিটি অফিসার কামরুল হাসান, ক্লিনিং সুপাইভাইজার আবু জাফর, মেকানিক মজিবর রহমান, প্রকৌশল হ্যাঙ্গারের মেকানিক ওসমান গনি, ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার সালেহ আহমেদ, হ্যাঙ্গারের কর্মী রায়হান ও মাকসুদ। এঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জন বিভিন্ন সময় সোনা পাচারের ঘটনায় গ্রেপ্তার হন। পরে আবার জামিনে মুক্তিও পান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের পরিচালক (প্রশাসন) রাজপতি সরকার গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এনবিআরের এই তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে বিমান কর্তৃপক্ষ এখনো অবহিত নয়। তিনি জানান, এর আগে বিমানের নিজস্ব তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে প্রকৌশল শাখার যাঁদের নাম এসেছিল, তাঁদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তবে কতজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে, তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।
তদন্ত প্রতিবেদনে চিহ্নিত বাকি চারজনের মধ্যে দুজন ওই ফ্লাইটের যাত্রী। তাঁরা হলেন ভারতীয় নাগরিক জ্যাসন প্রিন্স ও বাংলাদেশি নাগরিক জসিম উদ্দিন। এ ছাড়া ওই সোনার চালানের দাবিদার নেপালের নাগরিক গৌরাঙ্গ রোসান ও তাঁর এ দেশীয় প্রতিনিধি মিলন শিকদারকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিটির সদস্যরা গত ১৪ জানুয়ারি দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান। তাঁরা সেখানকার শুল্ক ও অভিবাসন বিভাগের সহযোগিতায় তদন্তে নিশ্চিত হন যে পাচারকারীরা বিমানের যাত্রী হয়ে দুবাই থেকেই ওই ১২৪ কেজি সোনা উড়োজাহাজে তুলেছেন। দুবাই শুল্কমুক্ত বিমানবন্দর হওয়ায় সেখানে সোনা বহনে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে পাচারকারী ওই যাত্রীদের উড়োজাহাজের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে ধারণা রয়েছে। তাঁরা কার্গো হোলের ঠিক ওপরে অবস্থিত টয়লেটের কমোডের পেছন দিয়ে সোনার বারগুলো ফেলে দেন। নির্দিষ্ট ছিদ্র দিয়ে বারগুলো কার্গো হোলের একটি নির্দিষ্ট প্যানেলে চলে যায়। সে প্যানেল থেকে সোনার বারগুলো বের করে আনার কাজ করেন বিমানের প্রকৌশল বিভাগের ওই ১০ কর্মী। ওই সোনার চালান হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৮ নম্বর ফটক দিয়ে বের করার কথা ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একাধিক যাত্রী ওই সোনা পাচারে জড়িত। এঁদের মধ্যে দুজনকে শনাক্ত করা হয়। তাঁরা জসিম উদ্দিন ও ভারতীয় নাগরিক জ্যাসন প্রিন্স। জসিম উদ্দিন গত বছরের ২০ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৩ মাসে মোট ৩১ বার দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করেছেন। পাসপোর্টে জসিমের পেশা দরজি বলে উল্লেখ রয়েছে। কমিটির কাছে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য জসিমকে তাঁর পাসপোর্টে উল্লিখিত ঠিকানায় একাধিকবার নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি আসেননি। পরে পুলিশের সহযোগিতায়ও হাজির করার চেষ্টা চলে। কিন্তু তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
অপর যাত্রী জ্যাসন প্রিন্সের সন্ধান পায়নি তদন্ত কমিটি। ঢাকা বিমানবন্দরের অভিবাসন কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর এখানকার অবস্থানের ঠিকানা দেওয়া হয় গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেল। কিন্তু ওই হোটেলে খোঁজ করে তদন্ত কমিটি জানতে পারে যে ওই ভারতীয় সেখানে ওঠেননি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আটকের পর ওই সোনার মালিকানা দাবি করে ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনারের কাছে আবেদন করেছেন নেপালের নাগরিক গৌরাঙ্গ রোসান। নেপাল থেকে পাঠানো এই আবেদনে তিনি সোনা আনার দায় স্বীকার করেন। একই সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে শুল্ক পরিশোধ করে তা তাঁর এ দেশীয় এজেন্ট মিলন শিকদারের অনুকূলে দেওয়ার আবেদন করেন। গৌরাঙ্গ রোসান তাঁর আবেদনে বলেন, তিনি মিলন শিকদারের কাছ থেকে ১২৪ কেজি সোনার দাম গ্রহণ করেছেন। তাই ওই সোনা যেন মিলন শিকদারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তদন্ত কমিটির প্রধান এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহপরিচালক মইনুল খান প্রথম আলোকে বলেন, চিহ্নিত ১৪ জনের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন, কাস্টমস আইনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইনে ফৌজদারি মামলা দায়ের করার সুপারিশ করেছে কমিটি।