মহাসড়কে মধ্যরাতে বিভীষিকা

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় মহাসড়কে ডাকাতির কবলে পড়া সোহাগ পরিবহনের বাসটিতে সামনের আসনে বসা আতঙ্কিত এক নারী যাত্রী। ডাকাতদের ধারালো অস্ত্রের আঘাত থেকে তিনিও রেহাই পাননি।ছবি: শরিফুল হাসান
ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় মহাসড়কে ডাকাতির কবলে পড়া সোহাগ পরিবহনের বাসটিতে সামনের আসনে বসা আতঙ্কিত এক নারী যাত্রী। ডাকাতদের ধারালো অস্ত্রের আঘাত থেকে তিনিও রেহাই পাননি।ছবি: শরিফুল হাসান

বিস্ময়, আতঙ্ক, কান্না, আর্তনাদ, রক্ত। ঢাকা-যশোর মহাসড়কে গতকাল রোববার দিবাগত রাত তিনটায় সোহাগ পরিবহনে ডাকাতির পর বাসের ভেতরের চিত্রটি ছিল এমনই।
ডাকাতেরা ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার আড়ুয়াকান্দি সেতুর কাছে রাস্তায় গাছ ফেলে বাসটিকে আটকায়। তারপর কুড়ালসহ ধারালো অস্ত্র হাতে উঠে পড়ে গাড়িতে। তারা যাত্রীদের টাকাপয়সা, মোবাইল ও অন্যান্য দামি জিনিস নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে অন্তত ১০ জনকে। ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায় যাচ্ছিল বাসটি।
ঢাকা থেকে মাইক্রোবাসে যাচ্ছিলাম মাগুরা। দিবাগত রাত তিনটায় আড়ুয়াকান্দি সেতু এলাকায় এসে থেমে গেলেন চালক। পাশে থামল আরও দুটি বাস। সামনে একটি বাস থেকে চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু কোনো গাড়ি থেকে কেউ নেমে সামনে যাচ্ছে না।

হাঁটুতে জখমপ্রাপ্ত এই যাত্রীকে মাগুরার সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। ডাকাতেরা তাঁর দুই হাঁটুতেই কোপ দেয়।ছবি: শরিফুল হাসান
হাঁটুতে জখমপ্রাপ্ত এই যাত্রীকে মাগুরার সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। ডাকাতেরা তাঁর দুই হাঁটুতেই কোপ দেয়।ছবি: শরিফুল হাসান

গাড়িতে বসেই ফরিদপুরের মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদকে ফোন করে রাস্তায় গাড়ি আটকে থাকার কারণ জানতে চাইলাম। ওসি জানালেন, রাস্তায় গাছ ফেলে রাখার কারণে গাড়ি যেতে পারছে না। মাইক্রোবাস থেকে নেমে ওই বাসটিতে গিয়ে উঠলাম। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই যাত্রীদের কান্না তীব্র হলো। তাঁরা জানালেন, কয়েক মিনিট আগে ডাকাতেরা নেমে গেছে। এলোপাতাড়ি কুপিয়েছে যাত্রীদের।
ওসির সঙ্গে আবার কথা হলো। আরও পুলিশ এল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাস্তা পরিষ্কার করে গাড়ি রওনা হলো। মধুখালীর পর কামারখালী সেতু পার হলেই মাগুরা জেলা শুরু। মিনিট দশেক পর বাসটি এসে থামল মাগুরা সদর হাসপাতালের সামনে। একে একে নামানো হলো আহত যাত্রীদের। ডাক্তার-নার্সরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। গুরুতর আহত ১০ জনকে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া শুরু হলো। জরুরি বিভাগজুড়ে মানুষের আর্তনাদ।
আবদুল্লাহ আল মামুন নামের এক যাত্রীর হাত থেকে রক্ত ঝরছে। মামুন জানালেন, তিনি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত। সাতক্ষীরায় যাচ্ছিলেন। মধুখালী আসার পর রাস্তায় গাছ দেখে বাসটি থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দুই পাশ থেকে গাড়ির দিকে ডাকাতেরা ঢিল ছোড়া শুরু করল। দরজা-জানালার কাচের ওপর কোপ দিচ্ছিল। একপর্যায়ে তিন ডাকাত ভেতরে ঢুকে পড়ে। তারা এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করল। মামুন বললেন, ‘আমার কাছে সাত হাজার টাকা ছিল, দিয়ে দিয়েছি। তবু আমাকে কুপিয়েছে।’
মধ্যবয়সী রওশনা বানুকে বাসেই কাঁদতে দেখেছিলাম। হাসপাতালে এসেও তাঁর কান্না থামছে না। তিনি জানালেন, স্বামী রফিকুল ইসলামকে নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। তাঁদের কাছে থাকা ১৮ হাজার টাকাই নিয়ে গেছে ডাকাতেরা। বাসের প্রথম সিটেই তাঁরা ছিলেন। দুজনকেই কুপিয়েছে। তাঁর স্বামীর দুই পায়ের আঘাত গুরুতর। তাঁকে জরুরি বিভাগ থেকে সার্জারি ওয়ার্ডে নেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহিম রক্তাক্ত। জানালেন, তাঁর কাছ থেকে ডাকাতেরা ছয় হাজার টাকা নিয়ে গেছে, আবার দা দিয়ে কোপও দিয়েছে।
৬০ বছরের বৃদ্ধ নজরুল ইসলামের সাদা পাঞ্জাবি রক্তে লাল। তাঁর পিঠে কুপিয়েছে ডাকাতেরা। তাঁর বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায়।
আরেক বৃদ্ধ মোসলেম উদ্দিন ঢাকায় ছেলেকে দেখে বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁকেও কুপিয়েছে ডাকাতেরা।
৩০ বছরের যুবক আবুল কালাম আজাদের কাছে নিজের দেশ বাংলাদেশ এখন এক আতঙ্কের নাম। তিনি জানালেন, চার বছর পর রোববারই মালয়েশিয়া থেকে ঢাকায় এসেছেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত হরতাল থাকার কারণে রাতে সাতক্ষীরার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তাঁর হাতে কুপিয়েছে ডাকাতেরা। নিয়ে গেছে মোবাইল ফোন, টাকা।
সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মমতাজ মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ১০ জনকে চিকিৎসা দিয়েছেন। এঁদের অবস্থা গুরুতর। ধারালো অস্ত্র মাংস ভেদ করে হাড়েও আঘাত করেছে কয়েকজনের।

এই যাত্রীর পিঠে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে ডাকাতেরা। মাগুরা সদর হাসপাতালে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।ছবি: শরিফুল হাসান
এই যাত্রীর পিঠে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে ডাকাতেরা। মাগুরা সদর হাসপাতালে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।ছবি: শরিফুল হাসান

বাসের সুপারভাইজার জি এম ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাত আটটায় ঢাকা থেকে সাতক্ষীরার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন তাঁরা। মধুখালী উপজেলার রেলস্টেশন থেকে কিছুটা এগিয়ে দেখেন, সামনে গাছ ফেলে রাখা। এরপর চারপাশ থেকে ঢিল। দা দিয়ে গ্লাসে কোপাচ্ছিল। বাধ্য হয়ে বাসের দরজা খুলে দিতে হয়েছে।
ঘটনাস্থল থেকে মধুখালী থানার দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ওই এলাকায় আমাদের চারটি টহল দল রয়েছে। কিন্তু পুলিশ যেখানে থাকে, ডাকাতেরা সেখানে থাকে না। কয়েক দিন আগে আমরা এমন এক জায়গায় দ্রুত পৌঁছার কারণে ডাকাতেরা কেটে পড়েছিল। কিন্তু কাল রাতে আমরা ঘ্টনাস্থলে যাওয়ার আগেই ডাকাতেরা ডাকাতি করে চলে যায়।’
মামলার প্রক্রিয়া চলছে জানিয়ে ওসি বলেন, এই এলাকাটি জঙ্গলের মতো। হঠাৎ করে গাছ ফেলে চলে যায়। আবার অনেক সময় ঢাকা থেকেও যাত্রীবেশী ডাকাত আসে। কয়েক দিন আগে কলকাতাগামী একটি বাসে এভাবে আধা ঘণ্টাজুড়ে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতি প্রতিরোধে আপনারা কী করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সারা রাত টহল দেই। আমরা চেষ্টা করছি। তবে সামনে শীত। কুয়াশা। এই এলাকাটা জঙ্গলের মতো।’
রাত তিনটায় যখন পুলিশ মহাসড়ক থেকে গাছ সরাচ্ছিল, তখন তাদের চোখেমুখেও ছিল আতঙ্ক। পুলিশের কয়েকজন সদস্য বলছিলেন, ভাই, দ্রুত গাড়ি নিয়ে চলে যান। কয়েকজন পুলিশÿক্ষোভ নিয়ে বললেন, ফরিদপুরের করিমপুরে হাইওয়ে পুলিশের একটি ফাঁড়ি আছে। কিন্তু কোনো গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়লে কেবল তাদের দেখা যায়। মহাসড়কের নিরাপত্তার দায়িত্ব তো তাদেরও।
জানতে চাইলে করিমপুরের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আরিফ হোসেন বলেন, ‘আমরা এখানে ৫৪ কিলোমিটার মহাসড়ক দেখি। মধুখালী এলাকায় যেখানে বারবার ঘটনা ঘটে, সেটি মধুখালী থানার দুই কিলোমিটারের মধ্যে। সেখানে তাদের টহল দেওয়ার কথা। বড় কথা হলো, বারবার একই এলাকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটছে।’
ফরিদপুর মোটর ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি মান্নান হাওলাদার বললেন, ‘আমরা পুলিশকে বারবার বলেছি, ব্যবস্থা নিন। কিন্তু আমরা বুঝি না, পুলিশ কী করছে। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হাইওয়ে পুলিশ করা হলো। কিন্তু নিরাপত্তা পাচ্ছি না।’
বাসমালিকদের দেওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে আমাদের ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, গত শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত মহাসড়কের মধুখালী-কামারখালী অংশে তিনটি বাস ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। গত শনিবার দিবাগত রাতে রায়পুর ইউনিয়নের ছুকরিকান্দি এলাকায় গাছ ফেলে একটি যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি হয়। গত শুক্রবার দিবাগত রাতে মধুখালী সদর ইউনিয়নের পরীক্ষিতপুর এলাকায় আরেকটি বাস ডাকাতির ঘটনা ঘটে।

রাত তিনটার দিকে মহাসড়কে ফেলে রাখা গাছের গুঁড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন মধুখালী থানার পুলিশ সদস্যরা l ছবি: শরিফুল হাসান
রাত তিনটার দিকে মহাসড়কে ফেলে রাখা গাছের গুঁড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন মধুখালী থানার পুলিশ সদস্যরা l ছবি: শরিফুল হাসান

ফরিদপুর বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতির জন্য সড়কে বাস ডাকাতি বেড়ে গেছে।
তবে মধুখালী থানার ওসি বলেন, ‘পর পর তিন দিন বাস ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে, তা আমাদের জানা নেই।’ তিনি বলেন, মহাসড়কে নিরাপত্তার দায়িত্ব হাইওয়ে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট থানার। তবে মাথা যেহেতু আমার, মাথাব্যথা আমাদেরই বেশি। হাইওয়ে পুলিশ সড়ক দুর্ঘটনার পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে।’
ফরিদপুর হাইওয়ে পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার বি এম আশরাফও বললেন, ‘পর পর তিন রাতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে, এজাতীয় কোনো ঘটনা আমার জানা নেই। কেউ অভিযোগও করেনি। তবে গত সপ্তাহে এ মহাসড়কের রাজবাড়ীর খানখানাপুর এলাকায় সৌদিয়া ও সোহাগ পরিবহনের দুটি বাসে ডাকাতি হয়েছিল। এ ব্যাপারে গোয়ালন্দ থানায় দুটি মামলা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ গত রোববার রাতে এক ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি বলেন, হাইওয়ে পুলিশ রাতে রাজবাড়ীর রাস্তার মোড় থেকে বসন্তপুর ও রাজবাড়ী রাস্তার মোড় থেকে মধুখালীর মাঝকান্দি জুট মিল পর্যন্ত টহল দেয়। বাকিটুকু মধুখালী থানার দেখার কথা। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা জান ও মালের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছি, তাদের সবাইকেই সতর্ক থাকতে হবে। দায়দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মাগুরা প্রতিনিধি]