মামলা করেও হতাশ ভুক্তভোগী পরিবার

উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় থানায় মামলা করার পরও স্বস্তি পাচ্ছে না ভুক্তভোগী পরিবার। তদন্তে ধীরগতি, পুলিশের অবহেলা এবং আসামি গ্রেপ্তারের পর দ্রুত জামিনে বের হয়ে আসায় পরিবারগুলো হতাশ।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বখাটেদের উৎপাতে আত্মহত্যা করেছে ১০ নারী। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে একজন, প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছে সাতজন, বখাটেদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে ১৩০ জন, উৎপাতকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে আহত হয়েছে ৫৭ জন এবং বখাটেদের উৎপাতে পাঁচজনের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এসব ঘটনার প্রতিটিতেই মামলা হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
কিন্তু উত্ত্যক্ত করাকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনায় মামলার বাদীপক্ষ বলছে, থানায় মামলা করে তারা স্বস্তিতে নেই। ঘটনা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশিত কিংবা প্রচারিত হলেই পুলিশ তৎপর হয়। আসামিকে গ্রেপ্তারও করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর সব থেমে যায়। এই সুযোগে জামিনে বের হয়ে আসে আসামিরা।
গত ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়ায় কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করে নবম শ্রেণির ছাত্রী উম্মে কুলসুম ওরফে ঋতু। পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, স্থানীয় বখাটে শিমুলসহ কয়েক যুবকের উৎপাত সইতে না পেরে কুলসুমের এমন আত্মহনন। ঘটনার পর কুলসুমের মা সাথী আক্তার বাদী হয়ে শিমুলসহ পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাতনামা কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পুলিশ শিমুলসহ এজাহারভুক্ত পাঁচজনের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি। শুধু গত ৮ সেপ্টেম্বর পুলিশ সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে শেখ মো. নেওয়াজ ইবনে আকরাম ওরফে জিহাদ নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু এক মাসের মাথায় জিহাদ জামিনে বেরিয়ে যায়। এ ঘটনায় গত ১৬ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হওয়া রফিক নামের আরেক সন্দেহভাজন এখন কারাবন্দী। এখন পুলিশসহ সবাই চুপ।
কুলসুমের স্কুলের এক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, এলাকাবাসী পুলিশকে তথ্য দিয়ে জিহাদকে গ্রেপ্তার করিয়েছে। অন্যদিকে পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের ওপর চাপ দিলে তারা রফিককেও পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। শুরু থেকেই এ ঘটনায় পুলিশকে পেশাগত জায়গা থেকে নিজেদের উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি।
কুলসুমের বাবা মো. আশিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ একদম ঠান্ডা। এখন পর্যন্ত মূল আসামিদেরই ধরতে পারেনি। জিগাইলে বলে, ধরতেছে। এ আশায় থাকতে থাকতে একজন জামিন পাইয়া গেল। আপনারা একটু লিখছিলেন বইলাই পুলিশ কিছু কাজ করছিল। এখন বন্ধ। মেয়ে হারাইছি, যন্ত্রণা ভুলতে পারি না। মামলা কইরা যে বিচার পামু, সে আশাও আর দেখতাছি না।’
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খিলগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান বলেন, ‘আসামি জিহাদ গত ১২ অক্টোবর জামিনে বের হয়ে গেছে বলে শুনেছি। তবে এখনো কাগজপত্র হাতে পাইনি।’ এজাহারভুক্ত আসামিরা কোথায়? জবাবে এসআই বলেন, আসামিদের অবস্থান এখনো শনাক্ত হয়নি। ফোনের কল তালিকা নিয়ে দেখেছি, তাদের সর্বশেষ অবস্থান ছিল চট্টগ্রামে।
রাজধানীর ভাষানটেকের নাসির হোসেন হত্যার ঘটনায়ও মামলা করে নিরাপত্তাহীনতায় আছে ভুক্তভোগী পরিবার। কারণ, এখন পর্যন্ত অর্ধেকেরও বেশি আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে। মামাতো বোনকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদের জের ধরে নাসির হোসেনকে (২৫) পিটিয়ে হত্যা করে ভাষানটেকের সন্ত্রাসীরা। ঘটনায় নাসিরের বড় ভাই মো. মোশারফ বাদী হয়ে সাতজনের নাম উল্লেখ করে থানায় হত্যা মামলা করেন। পরে আরও সাতজন আসামির নাম পুলিশের কাছে জমা দেন তিনি।
তবে এ ঘটনায় আসামি না ধরে বাদীপক্ষকে সামাল দিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে ভাষানটেক থানার পুলিশ। ঘটনাকে ‘উত্ত্যক্তের প্রতিবাদে হত্যা’ নয় বলে দাবি করে থানার পুলিশ। এ মর্মে নাসিরের মামাকে দিয়ে জোর করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করারও অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। আসামিদের সঙ্গে পুলিশের সখ্যেরও অভিযোগ ওঠে। এ কারণে নাসির হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ ভাষানটেক পুলিশ ফাঁড়ির ১৯ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। প্রত্যাহার করা হয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও পরিদর্শককে (তদন্ত)।
এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) টাঙ্গাইল থেকে এজাহারভুক্ত আসামি মো. শরীফ ওরফে চোক্কা ও রাজধানীর গাবতলী থেকে এজাহারভুক্ত বাবুল ব্যাপারী ওরফে বাবলু ও সন্দেহভাজন আলতাফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। এই তিনজন ছাড়া এখন পর্যন্ত ১১ জন এজাহারভুক্ত ও সন্দেহভাজন আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অর্ধেকেরও বেশি আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় আতঙ্কে আছে ভুক্তভোগী পরিবার। এরই মধ্যে ভয়ে ভাষানটেক এলাকা ছেড়েছেন নাসিরের দুই বোন।
নাসিরের বড় ভাই মো. মোশারফ বলেন, এখন নাসিরের পরিবার বলতে তিনিই এলাকায় আছেন। আসামিরা এলাকার আশপাশেই আছে এবং তাঁকে হুমকি দিয়েই যাচ্ছে।
মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে ডিবি। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে ডিবি।