নিজামীর মামলার রায় পড়া শুরু

জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় পড়া শুরু করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আজ বুধবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটে ২০৪ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু হয়। 
নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণার ধার্য দিনে আজ বেলা ১১টায় ট্রাইব্যুনালের এজলাসে আসেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
বেলা ১১টার কয়েক মিনিটে আগে নিজামীকে হাজতখানা থেকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় আনা হয়। কাঠগড়ায় তাঁকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।
আসন গ্রহণের পর ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম সূচনা বক্তব্যে বলেন, ‘রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ দীর্ঘ দিন ধরে রায়ের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। আমারও অপেক্ষায় ছিলাম—কখন রায় দিতে পারব। দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে বিভিন্ন মহল ও গণমাধ্যমে নানা কথা উঠেছে। এসব কথা আমলে নেওয়া ও জবাব দেওয়ার সুযোগ আমাদের নেই। জবাব দেওয়া উচিতও হবে না। আদালত রাস্তায় গিয়ে কথা বলতে পারেন না। আমরা বোবার মতো থাকি। মন্তব্য করার ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত, আমরা (আদালত) কোনো জবাব দিতে পারব না।’
ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা নিজের বিবেক, আইন ও সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হই। আমাদের ওপর কোনো নির্দেশ নেই। আমরা আপসও করি না। আপস করি আইন ও সংবিধানের সঙ্গে।’
বেলা ১১টা ১০ মিনিটে প্রারম্ভিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক। ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন তাঁর অংশের রায় পড়া শুরু করেন বেলা ১১টা ৩৬ মিনিটে। 
ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিজামী

নিজামীকে আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল মঙ্গলবার দ্বিতীয় দফায় এই মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন। রায় ঘোষণা উপলক্ষে নিজামীকে সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে হাজির রাখার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। নির্দেশ অনুযায়ী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তাঁকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নেওয়া হয়। এর আগে গতকাল সন্ধ্যায় তাঁকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।
রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও এর আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। হাইকোর্ট ও ট্রাইব্যুনালে প্রবেশের সবগুলো ফটকে পুলিশ ও র‌্যাব অবস্থান নিয়েছে। ভেতরে প্রবেশের ক্ষেত্রে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি তল্লাশিও করা হচ্ছে।
দোয়েল চত্বর থেকে হাইকোর্ট মাজার পর্যন্ত সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্ট মাজার ফটকের বাইরে অবস্থান নিয়েছে পুলিশের সাঁজোয়া যান। শাহবাগ মোড়েও অবস্থান নিয়েছে পুলিশ।
এ ছাড়া রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আজ রাজধানীসহ দেশব্যাপী নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। গতকাল রাত থেকেই রাস্তায় নেমেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, নিজামীর রায়কে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগরে থাকছে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা। থাকছে তল্লাশি চৌকি, অতিরিক্ত টহল।
ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, ঢাকার বাইরের জেলাগুলো, বিশেষ করে যেসব জায়গায় গত বছর ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও হয়েছিল, সেসব জেলায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর মধ্যে এ পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার বিচার কার্যক্রম। এর রায়ও অপেক্ষমাণ সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। গত বছরের ১৩ নভেম্বর প্রথম দফায় এ মামলার কার্যক্রম শেষে যেকোনো দিন রায় ঘোষণা করা হবে বলে জানান ট্রাইব্যুনাল। সেই থেকে এই রায়ের জন্য অপেক্ষার শুরু। রায় ঘোষণার আগেই ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান ট্রাইব্যুনাল-১-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর।
এর ৫৩ দিন পর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল দ্বিতীয় দফায় মামলার সমাপনী যুক্তি শোনেন। ২৪ মার্চ মামলাটি দ্বিতীয় দফায় রায়ের অপেক্ষায় (সিএভি-কেস অ্যায়োটিং ভারডিক্ট) রাখা হয়। এর তিন মাস পর ২৪ জুন রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়।
কিন্তু রায় ঘোষণার দিন সকালে কারাগারে আটক নিজামী হঠাৎ ‘অসুস্থ’ হয়ে পড়েন। কারা কর্তৃপক্ষ ট্রাইব্যুনালকে জানায়, তাঁকে হাজির করা সম্ভব নয়। ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসামির অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা যুক্তিসংগত নয়। এ জন্য মামলাটি আবারও রায়ের অপেক্ষায় রাখা হয়।
ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন, আসামি সুস্থ হয়ে উঠলে যত দ্রুত সম্ভব রায় ঘোষণা করা হবে। ৩ জুলাই নিজামীর সুস্থতার প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। এর প্রায় চার মাস পর দ্বিতীয় দফায় এই রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়।
২০১২ সালের ২৮ মে ১৬টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলায় নিজামীর বিচার শুরু হয়। প্রায় দেড় বছর ধরে সাক্ষ্য গ্রহণ চলে। এই মামলার দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ, একই সময়ে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলারও বিচার চলছিল। এ জন্য ওই মামলার অন্যতম আসামি নিজামীকে সপ্তাহে দুই দিন চট্টগ্রামে নেওয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার কার্যক্রম ব্যাহত হয়। গত ৩০ জানুয়ারি ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে নিজামীর সর্বোচ্চ সাজা আশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ। তাঁদের দাবি, নিজামীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তাঁরা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন। একই সঙ্গে এসব অপরাধ সংঘটনে নিজামীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের দায়ও প্রমাণিত হয়েছে।
পক্ষান্তরে আসামিপক্ষের দাবি, মিথ্যা তথ্য ও ভুয়া সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এসব অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি। এ জন্য নিজামীকে খালাস দেওয়া উচিত।
১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী নিজামী ১৯৭১ সালে নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন, বর্তমান নাম ইসলামী ছাত্রশিবির) সভাপতি ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, নিজামী একাত্তরের কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
আজ নিজামীর রায় ঘোষণা হলে দুটি ট্রাইব্যুনাল এ নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১০টি মামলার রায় ঘোষণা করবেন।