মন্ত্রী হয়েও তাঁরা কোম্পানির পরিচালক

.
.

তাঁরা চারজন। মোশাররফ হোসেন, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও জাহিদ মালেক। প্রথম দুজন মন্ত্রী আর শেষের দুজন প্রতিমন্ত্রী। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ চার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন তাঁরা। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তাঁরা ‘সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের’ শপথ নিয়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরও এই চারজনই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত লাভজনক কোম্পানি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। প্রথম আলোর তথ্যানুসন্ধানে এর সত্যতাও মিলেছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর লাভজনক কোনো কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ নেই। কেউ যদি এটি করে থাকেন, তাহলে তা ‘সংবিধানের লঙ্ঘন’।
সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সরকারের কোনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী পদে নিযুক্ত বা কর্মরত ব্যক্তি কোনো লাভজনক পদ কিংবা বেতনাদিযুক্ত পদ বা মর্যাদায় বহাল হইবেন না কিংবা মুনাফালাভের উদ্দেশ্যযুক্ত কোন কোম্পানি, সমিতি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় বা পরিচালনায় কোনোরূপ অংশগ্রহণ করিবেন না।’
মন্ত্রী ছাড়াও রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, নির্বাচন কমিশনার ও সরকারি কর্মকমিশনের সদস্যের বেলায়ও সংবিধানের এ ধারা প্রযোজ্য।
প্রথম আলোর তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি দ্য পেনিনসুলা চিটাগাং লিমিটেডের চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন। সম্প্রতি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও অনুমোদন পাওয়া শাশা ডেনিমস লিমিটেডের পরিচালক পদে রয়েছেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ তালিকাভুক্ত কোম্পানি আরামিট সিমেন্ট লিমিটেড এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বিডি থাই অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড ও সানলাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের পরিচালক পদে রয়েছেন।
বিএসইসিতে জমা দেওয়া কোম্পানিগুলোর পরিচালকদের হালনাহাদ তথ্য, যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি), বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ বা বেপজা ও কোম্পানির নিজস্ব ওয়েবসাইটসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার তথ্য যাচাই করে চার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর লাভজনক কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর কোনো ধরনের লাভজনক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা বা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকার বিধান নেই। যদি কোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী সেটি করে থাকেন, তাহলে তা সরাসরি সংবিধান লঙ্ঘন। আর এ কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হিসেবে পদে বহাল থাকার অযোগ্য হয়ে যাবেন।’
সুপ্রিম কোর্টে কোম্পানি আইন নিয়ে কাজ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেও জানা যায়, কোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কোম্পানির পরিচালক পদে থাকলে সেটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সাংবিধানিক পদের ক্ষেত্রে কোম্পানির পরিচালক পদটিকে লাভজনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, পদটির সঙ্গে কিছু আর্থিক সুবিধা জড়িত থাকে। তাঁরা আরও বলেন, বাংলাদেশের কোম্পানি আইন অনুযায়ী একজন শেয়ারধারী যখন পরিচালক হিসেবে নির্বাচিত হন, তখন সেটিকে লাভজনক পদ হিসেবে গণ্য করা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে একজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বেলায় কোম্পানির পরিচালক পদ লাভজনক হিসেবে বিবেচনায় ধরা হয়। কারণ, পরিচালনা পর্ষদের সভায় অংশ নিলে পরিচালকদের সম্মানী দেওয়া হয়।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংবিধান হলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সেই আইন অনুযায়ী মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর কারও অন্য কোনো লাভজনক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিধান নেই। অতীতে অনেকেই মন্ত্রী হওয়ার আগে অন্য লাভজনক পদ ছেড়ে দিয়েছেন। এখন কেউ যদি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরও লাভজনক পদে থাকেন, তাহলে সেটি সম্পূর্ণ বেআইনি।’
ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: গত জুনে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় সেবা খাতের চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দ্য পেনিনসুলা চিটাগাং। চলতি বছরের ৩০ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত দেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে আইপিও অর্থ সংগ্রহ করে। সে সময় যে প্রসপেক্টাস বা আইপিও বিবরণীপত্র প্রকাশ করেছে, তাতে চেয়ারম্যান হিসেবে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের নাম রয়েছে। মন্ত্রী হিসেবে মোশাররফ হোসেন দায়িত্ব নিয়েছেন চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি। আর তাঁর মালিকানাধীন কোম্পানি শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলেছে মার্চ-এপ্রিলে। অর্থাৎ মন্ত্রী পদে বহাল হওয়ার পরও তিনি পেনিনসুলার পরিচালক রয়েছেন।
সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী, আইপিও প্রসপেক্টাস আইনগত দলিল বা লিগ্যাল ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই প্রসপেক্টাসে কোনো ভুল বা মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করা হলে তা সরাসরি সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন।
জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পেনিনসুলা আমার পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ব্যবসা। বর্তমানে এটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ও আমি সেটির চেয়ারম্যান। প্রতিষ্ঠানটি সরকারের সঙ্গে কোনো ব্যবসা করে না। মন্ত্রী হলে ব্যবসা করা যাবে না—এমন কোনো বিধানের কথা আমার জানা নেই।’
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ: ১৪ অক্টোবর বিএসইসির সভায় আইপিওর অনুমোদনপ্রাপ্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি শাশা ডেনিমসের পরিচালক পদে রয়েছেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা বা ডিইপিজেডে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি। আগে তিনি কোম্পানিটির চেয়ারম্যান থাকলেও সম্প্রতি সেই দায়িত্ব স্ত্রী পারভীন মাহমুদের কাছে হস্তান্তরের আবেদন করেছেন। কোম্পানিটির পরিচালক পদে এখনো বহাল রয়েছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এ বিষয়ে কথা বলতে আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে মুঠোফোন ও খুদে বার্তায় যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
জাহিদ মালেক: আইডিআরএর কাছে সানলাইফ ইনস্যুরেন্সের পরিচালকদের হালনাগাদ যে তথ্য রয়েছে, সেখানে পরিচালক হিসেবে জাহিদ মালেকের নাম রয়েছে। এমনকি আরজেএসসির হালনাগাদ তথ্য ও কোম্পানিটির ওয়েবসাইটের পরিচালক হিসেবে তাঁর নাম রয়েছে।
গত ২৮ অক্টোবর সানলাইফ ইনস্যুরেন্সের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পরিচালক হিসেবে জাহিদ মালেকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীর পরিচয়টিও উল্লেখ রয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন। কোম্পানিটির পক্ষ থেকে বিএসইসিতে জমা দেওয়া সর্বশেষ শেয়ারধারণ-সংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, পরিচালক জাহিদ মালেকের হাতে সানলাইফ ইনস্যুরেন্সের প্রায় সোয়া ৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিডি থাই অ্যালুমিনিয়াম তার উদ্যোক্তা-পরিচালকদের গত সেপ্টেম্বরের শেয়ারধারণ-সংক্রান্ত যে তথ্য বিএসইসিতে জমা দিয়েছে, তাতেও উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে নাম রয়েছে জাহিদ মালেকের। ওই কোম্পানির প্রায় ৫৬ লাখ শেয়ার রয়েছে তাঁর হাতে। বিডি থাই অ্যালুমিনিয়ামের কোম্পানি সচিব জাহিদুল আলম স্বাক্ষরিত শেয়ারধারণ-সংক্রান্ত চিঠি ২ অক্টোবর বিএসইসিতে জমা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জাহিদ মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণের পর আমি চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিয়েছি। তবে দুই কোম্পানিতেই আমি পরিচালক হিসেবে আছি। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আমার কার্যালয় থেকে আমাকে বলা হয়েছে, পরিচালক থাকার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। পারিবারিক সূত্রে আমি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাই চাইলেও এসব ব্যবসা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব না। কারণ, পারিবারিকভাবে আমি অনেক ব্যবসায়িক সম্পদের উত্তরাধিকারী। তবে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর কোম্পানিগুলোর কাজের সঙ্গে আমি সরাসরি আর যুক্ত নই।’
সাইফুজ্জামান চৌধুরী: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি আরামিট সিমেন্ট ২ অক্টোবর উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ারধারণ-সংক্রান্ত সর্বশেষ যে তালিকা বিএসইসিতে জমা দিয়েছে, তাতে কোম্পানিটির পরিচালক হিসেবে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নাম রয়েছে। ৫০ লাখের বেশি শেয়ার নিয়ে তিনি এ পদে রয়েছেন। এ ছাড়া ২৮ অক্টোবর আরামিট গ্রুপের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নাম রয়েছে। এর বাইরে আরজেএসসি সূত্রে জানা গেছে, আরামিট ফুটওয়্যার (তালিকাভুক্ত নয়) নামের অপর একটি কোম্পানির পরিচালক পদেও রয়েছেন ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। এ নিয়ে চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়নি।
বিএসইসির ভূমিকা: আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানের বিধান নিশ্চিত করার আইনগত দায়িত্ব বিএসইসির ওপর না বর্তালেও বিষয়টি তাদের নজরে আসার পর সংশ্লিষ্ট মহলকে অবহিত করা উচিত ছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ফারমার্স ব্যাংক নামে তাঁর মালিকানাধীন একটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথমে মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে চেয়ারম্যান ও পরিচালক রেখে ফারমার্স ব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদনের আবেদন জানানো হয়। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক অনানুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি তোলে। এর পরই চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদ ছাড়েন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ পড়ার পর তিনি পুনরায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে ফিরে আসেন।
আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকার পরও সংবিধান সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের উদ্যোগ নিলেও শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং মন্ত্রীর মালিকানাধীন কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার আবেদন অনুমোদনের ক্ষেত্রে সংস্থাটির বিশেষ তৎপরতা বা বাড়তি আগ্রহ ছিল। এমনকি মন্ত্রীর কোম্পানির আবেদন-প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার জন্য প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চাপ দেন বিএসইসির শীর্ষ ব্যক্তিরা।
এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে বিএসইসির কেউই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।