সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার

মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের করা আপিলের রায় আজ সোমবার ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টে প্রবেশের তিনটি ফটকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন। ভেতরে প্রবেশের ক্ষেত্রে পরিচয় নিশ্চিত করা হচ্ছে। সন্দেহ হলে তল্লাশি করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সুপ্রিম কোর্টের ভেতরেও রয়েছেন।
আজ সকাল নয়টায় আদালত বসার কথা। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের করা আপিলের রায় দেবেন। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্‌হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
সুপ্রিম কোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রা​র এস এম কুদ্দুস জামান গতকাল রোববার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, আপিল বিভাগের সোমবারের কার্যতালিকায় রায় ঘোষণার জন্য আপিলটি ১ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে।
এ রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। এটি হবে আপিল বিভাগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তৃতীয় রায়। কামারুজ্জামানের করা আপিলের শুনানি শেষে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। এর এক মাস ১৬ দিনের মাথায় এ রায় হচ্ছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আশা করি, এই দণ্ড বহাল থাকবে।’ আর কামারুজ্জামানের আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, ‘আমরা রায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। সর্বোচ্চ আদালতের ন্যায়বিচারের প্রতি আমরা আস্থাবান ও শ্রদ্ধাশীল। আশা করি, আপিলকারী খালাস পাবেন।’
গত বছরের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। তাঁর বিরুদ্ধে আনা সাতটির মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ও খালাস চেয়ে গত বছরের ৬ জুন আপিল করেন তিনি। তবে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেনি। চলতি বছরের ৫ জুন থেকে আপিলের শুনানি শুরু হয়। ১৬তম দিনে ১৭ সেপ্টেম্বর শুনানি শেষ হয়।
গত বুধবার জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও গতকাল দলের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর মামলার রায়সহ দুটি ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত ১১টি মামলার রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত সাতটিতে দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। তবে পলাতক আবুল কালাম আযাদ এবং চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান আপিল করেননি। চূড়ান্ত রায় হয়েছে দুটির। এর মধ্যে ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন। আর অপরটিতে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং এ দণ্ড ১২ ডিসেম্বর রাতে কার্যকর হয়।
দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার পর জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম এবং বিএনপির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম মারা গেছেন। আলীমের মৃত্যুতে তাঁর করা আপিল অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর ‘বিধবাপল্লীতে’ নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড এবং গোলাম মোস্তফা হত্যাকাণ্ডের দায়ে (তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ) তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।
বদিউজ্জামান ও দারাসহ ছয়জনকে হত্যার (প্রথম ও সপ্তম অভিযোগ) দায়ে যাবজ্জীবন এবং একাত্তরে শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানের প্রতি অমানবিক আচরণের দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
রাজধানীর পল্লবী থানায় করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ১৩ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২ অক্টোবর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ জুন ট্রাইব্যুনাল তাঁর বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ গঠন করেন। ২ জুলাই এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রমাণিত পাঁচ অভিযোগ: প্রথম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২৯ জুন সকালে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদর সদস্যরা শেরপুরের ঝিনাইগাতি থানার রামনগর গ্রামের আহম্মেদ মেম্বারের বাড়ি থেকে মো. ফজলুল হকের ছেলে বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে আহম্মেদনগর সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে সারা রাত তাঁকে নির্যাতন করে পরদিন গুলি করে হত্যা করা হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগ, একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি এক বিকেলে কামারুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করে।
তৃতীয় অভিযোগ, একাত্তরের ২৫ জুলাই সকালে আলবদর ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় ও নারীদের ধর্ষণ করে। ওই হত্যাযজ্ঞের পর থেকে গ্রামটি ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত হয়।
চতুর্থ অভিযোগ, একাত্তরের ২৩ আগস্ট কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা শেরপুর শহরের কলেজ মোড় এলাকা থেকে গোলাম মোস্তফাকে ধরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে স্থাপিত আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। গোলাম মোস্তফার চাচা তোফায়েল আহমেদ সেখানে কামারুজ্জামানের কাছে গিয়ে তাঁকে (গোলাম মোস্তফা) ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু রাতে কামারুজ্জামান ও আলবদর সদস্যরা গোলাম মোস্তফা ও আবুল কাসেম নামের একজনকে সেরিহ সেতুর কাছে নিয়ে গুলি করে। গোলাম মোস্তফা নিহত হন এবং আঙুলে গুলিবিদ্ধ কাসেম নদীতে লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচে যান।
সপ্তম অভিযোগ, মুক্তিযুদ্ধকালে ২৭ রমজান বেলা একটার দিকে কামারুজ্জামান ১৫-২০ জন আলবদর সদস্যকে নিয়ে ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানার কাঁচিঝুলি গ্রামের গোলাপজান রোডে ট্যাপা মিয়ার বাড়িতে হামলা চালান। ট্যাপা ও তাঁর বড় ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে অবস্থিত আলবদর ক্যাম্পে নেওয়া হয়। পরদিন সকালে আলবদররা তাঁদের আরও পাঁচজনের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে নিয়ে সারিতে দাঁড় করায়। প্রথমে ট্যাপাকে বেয়নট দিয়ে খোঁচাতে গেলে তিনি নদীতে লাফিয়ে পড়েন। আলবদররা গুলি করলে তাঁর পায়ে লাগে, তবে তিনি পালাতে সক্ষম হন। অন্য ছয়জনকে বেয়নেট দিয়ে খঁুচিয়ে হত্যা করা হয়।