ঈদে ঘরমুখী মানুষের যাত্রা শুরু স্বস্তিতে

ঈদে ঘরমুখী মানুষের ট্রেনযাত্রা ‘স্বস্তির’ হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ৩০টি ট্রেনের মধ্যে ২৭টিই মোটামুটি সময়মতো রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ছেড়েছে।

কল্যাণপুর, গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া দূরপাল্লার বাসের যাত্রীরাও গতকাল বলতে গেলে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে যেতে পেরেছেন। বাসে ওঠার আগে বৃষ্টির কারণে ভোগান্তি ছাড়া তাঁদের তেমন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। তবে যানজটে আটকা পড়ে ট্রেন বা বাস হারাতে পারেন—এমন দুশ্চিন্তায় যাত্রীদের অনেকে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই স্টেশন বা টার্মিনালে এসেছেন।

বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, সকালে চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী, দিনাজপুরগামী একতা ও খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেন নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে। কমলাপুর থেকে মহানগর সকাল সাতটা ৪০ মিনিট, সুন্দরবন ভোর ছয়টা ২০ মিনিট এবং একতা সকাল ১০টায় ছাড়ার সময় নির্ধারিত আছে। তিনটি ট্রেনই দেরিতে আসায় ছাড়তেও দেরি হয়েছে। একতা অনেক স্টপেজে থামে বলে আসতেই তিন ঘণ্টা দেরি করে। অবশ্য কমলাপুর আসার পর অন্য একটি ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেনটি পাঠিয়ে দেওয়ায় তিন ঘণ্টার বদলে এক ঘণ্টা দেরি হয়।

রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, কিছু ট্রেন ছাড়তে ১০ মিনিট দেরি হয়। সেটা দেরির হিসাবে আনা হয় না। ২০ মিনিট দেরি হলে তা নথিভুক্ত করা হয়।

চট্টগ্রামগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস ও মহানগর গোধূলীর কমলাপুর স্টেশন ছাড়ার নির্ধারিত সময় যথাক্রমে বেলা তিনটা ও তিনটা ২০ মিনিটে। গতকাল দুটি ট্রেনই নির্ধারিত সময়ে কমলাপুর ছেড়ে গেছে। ট্রেন ছাড়ার আগমুহূর্তে সুবর্ণ এক্সপ্রেসের যাত্রী আরাফাত রহমান ও তাঁর স্ত্রী ফারহানা রহমান বলেন, ‘মাইকে ট্রেন সময়মতো ছাড়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, ট্রেনে ঈদযাত্রা স্বস্তিরই হবে।’

রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, গতকাল পর্যন্ত ট্রেন মোটামুটি সময় মেনে চলেছে। আজ বুধবার ও আগামীকাল বৃহস্পতিবার যাত্রী বেড়ে যাবে। সবাইকে নিরাপদে নামিয়ে দিতে প্রতিটি স্টেশনে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছু সময় বেশি থামানো হবে। ফলে সময় মেনে চলা কঠিন হবে। তবে কোনো দুর্ঘটনা না হলে সময়সূচিতে বড় ধরনের বিপর্যয় হবে না।

যানজটের ভয়ে কয়েক ঘণ্টা আগেই স্টেশনেমহানগর গোধূলীতে ফেনী যেতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বেলা দুইটায় কমলাপুর পৌঁছান মো. আলমগীর। ট্রেন ছাড়ার এক ঘণ্টা ২০ মিনিট আগে স্টেশনে আসা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, তাঁর বাসা রামপুরায়। গত বছর মহানগর প্রভাতীর টিকিট কাটলেও যানজটে আটকে ট্রেন ধরতে পারেননি। পরে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেক কষ্টে বাসে গিয়েছিলেন। তাই এবার আগেই স্টেশনে চলে এসেছেন।

নোয়াখালীগামী উপকূল ট্রেনের যাত্রী জিন্নাহ আহমেদও পরিবার নিয়ে কমলাপুরে আসেন বেলা দুইটায়। ওই ট্রেন ছাড়ার কথা বিকেল চারটা ২০ মিনিটে। প্রায় একই সময়ে স্টেশনে দেখা হয় আঞ্জুয়ারা বিবির সঙ্গে। তিনি স্বামী-সন্তানসহ যাবেন সিরাজগঞ্জে। বিকেল পাঁচটার সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে চাপতে তাঁরা মিরপুর ১৩ নম্বর থেকে কমলাপুরের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন দুপুর ১২টায়। ভয় ছিল, যদি যানজটে আটকে পড়েন। তবে স্টেশনে পৌঁছান পৌনে দুইটায়। সেই থেকে অপেক্ষা করছিলেন ট্রেনের জন্য।

এভাবে যানজটের ভয়ে ট্রেন ছাড়ার অনেক আগেই স্টেশনে এসে বসে থাকা অনেকের মধ্যে স্কুলশিক্ষক হারুন আর রশিদ, গৃহিণী বিবি মরিয়ম, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফারুক আহমেদসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

দুপুরে পুরো প্ল্যাটফর্মে গিজগিজ করছিল মানুষ। তবে ছিল না হইচই। হুইসেল বাজিয়ে একেকটি ট্রেন গন্তব্যের উদ্দেশে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ছে, আরেকটি ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াচ্ছে।

ঈদের পরের টিকিটেরও ব্যাপক চাহিদাট্রেনের টিকিট বিক্রির সঙ্গে জড়িত একাধিক কর্মকর্তা জানান, ঈদের পর ১১ ও ১৪ আগস্টের টিকিটের ব্যাপক চাহিদা দেখা গেছে। ৯ আগস্ট ঈদ হলে ১০ আগস্ট প্রায় সব ট্রেন বন্ধ থাকবে। অল্প কিছু লোকাল ট্রেন চলবে। সেই বিবেচনায় প্রতিবার ঈদের এক দিন পর পর্যটন এলাকাগুলোয় যাওয়ার ট্রেনে ভিড় থাকে। এবার সঙ্গে যোগ হয়েছে ১৪ আগস্ট। কারণ, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি এবং পরের দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি।

কমলাপুর স্টেশনের টিকিট কাউন্টারগুলোতে ১১ ও ১৪ আগস্টের টিকিটের জন্য মানুষের সারি দেখা গেছে।

রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) সরদার সাহাদাত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের পর বেড়ানোর উদ্দেশ্যে যাওয়া মানুষের ভিড় থাকে। এবার টানা ছুটির কারণে ১১ ও ১৪ আগস্টের টিকিটের চাপটা একটু বেশি।

বৃষ্টির জন্য ভোগান্তিঈদে ঘরমুখী যাত্রায় নয়, যাত্রা শুরুর জন্য বাসে ওঠার আগে বৃষ্টির জন্য ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। সারা দিন থেমে থেমে বৃষ্টির মধ্যেও ঢাকা ছেড়েছেন অনেক মানুষ। ভিজে চুপসে বাসে উঠতেও দেখা যায় কয়েকজনকে। এর পরও তাঁদের মুখে ছিল আনন্দের ছাপ।

বেলা একটায় গাবতলী বাস টার্মিনাল ও কল্যাণপুরে বিভিন্ন বাসের কাউন্টারের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, স্বাভাবিক দিনের তুলনায় বেশি যাত্রীর ভিড়। এসআর ট্রাভেলসের উপমহাব্যবস্থাপক মো. প্লাবন জানান, ৫ আগস্ট থেকে লোকজন রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এবার আগেভাগে ঈদের ছুটি হওয়ায় অনেক পরিবার আগেই গ্রামে চলে গেছে। তাই গতবারের মতো বাড়তি চাপ নেই। এসআর ট্রাভেলস ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করে।

এদিকে ঈদের পর জামায়াতে ইসলামীর ডাকা টানা দুই দিনের হরতালের কারণে অনেকে সিদ্ধান্ত বদলে বাড়ি না যাওয়ার মনস্থির করেছেন। ফেরার ঝামেলার আশঙ্কায় তাঁরা অগ্রিম কেনা টিকিট ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁদের একজন একটি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের চাকুরে সাব্বির হোসেন জানান, তিনি ঈদের দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত ছুটি নিয়েছিলেন। কিন্তু ‘অপ্রত্যাশিত হরতালের’ কারণে সিদ্ধান্ত বদলে কেনা টিকিট বিক্রির চেষ্টা করছেন। এবার পরিবার নিয়ে ঢাকায়ই ঈদ করবেন।

একাধিক বাস কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, গতকাল ঢাকা-আরিচা ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজট ছিল না। ফলে মানুষের ভোগান্তি হয়নি।

মহাখালী বাস টার্মিনালেও ঈদে ঘরমুখী যাত্রীদের ভিড় দেখা গেছে। কাউন্টারগুলোর সামনে সারিতে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে যাত্রীদের বাসে উঠতে দেখা গেছে।

ঈদে সেবা দিতে সরকারি পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) বেশ কিছু নতুন বাস ছেড়েছে। বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ জানায়, ঢাকা থেকে রংপুর, নীলফামারী, ময়মনসিংহ, নাটোর, রাজশাহী, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন গন্তব্যে ঈদ উপলক্ষে প্রায় ১০০টি বিশেষ বাস ছাড়া হয়েছে।