নিখোঁজ ব্যক্তিরা 'গ্রেপ্তার' হচ্ছেন!

রাজধানীর মগবাজার থেকে গত ২৮ আগস্ট রাতে জাহিদুল ইসলাম ওরফে সোহেল নামে এক ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। জাহিদুল ক্যানসারে ভুগছিলেন। র‌্যাব-পুলিশ সব জায়গায় খুঁজে কোনো সন্ধান না পেয়ে তাঁর স্বজনেরা পরদিন বাড্ডা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরে ২৭ সেপ্টেম্বর আরও চারজনের সঙ্গে জাহিদুলকেও মগবাজারের তিন খুনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় র‌্যাব।
যদিও পরে ওই মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানিয়েছে, ওই হত্যার ঘটনার সঙ্গে জাহিদুলের কোনো সংশ্লিষ্টতা মেলেনি। পরে জাহিদুলকে সন্দেহভাজন হিসেবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
জাহিদুলের মতো একের পর এক ‘অপহৃত’ বা ‘নিখোঁজ’ হওয়া অনেককেই পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে পাওয়া গেলেও এর কোনো ব্যাখ্যা মিলছে না। বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, অপরাধীরা নিজেরা আত্মগোপনে থেকে অপহরণের নাটক সাজাচ্ছে।
সর্বশেষ ৩০ অক্টোবর গভীর রাতে সিরাজগঞ্জ থেকে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গি হিসেবে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার দেখায় র‌্যাব। এদের একজন নুরুজ্জামান আরিফ এক মাস আগে ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন বলে তাঁর পরিবার পরদিন মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করে।
এ বিষয়ে জানতে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিখোঁজের’ বিষয়ে ওই জিডি হওয়ার পর আরিফের মুঠোফোন নম্বর ধরে খোঁজাখুঁজি করেছে পুলিশ, আশপাশের থানায় বেতারবার্তাও দিয়েছে। কিন্তু কোনো তথ্য মেলেনি। নিখোঁজ ওই ব্যক্তিকে এক মাসের মাথায় কীভাবে গ্রেপ্তার করা হলো, সে বিষয়ে র্যা বের কাছে কিছু জানতেও চায়নি পুলিশ।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮২ জনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ করা হয়েছে বলে তাঁদের পরিবার অভিযোগ করেছে। এঁদের মধ্যে আটজনকে পরে গ্রেপ্তার দেখায় র‌্যাব ও পুলিশ। ২৩ জনের লাশ মিলেছে। ১২ জন বিভিন্ন সময়ে ছাড়া পান। এমন কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, কারা ধরে নিয়েছিল, তা নিয়ে কিছু বলতে রাজি হননি। বাকি ৩৮ জনের কোনো খোঁজ এখনো মেলেনি।
আসকের মানবাধিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ২৬৮ জনকে অপহরণ করা হয়। এঁদের মধ্যে ১৪ জনকে পরে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ৪৩ জনের লাশ পাওয়া যায়। ছাড়া পান ২৪ জন। বাকিরা এখনো নিখোঁজ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে র‌্যাব ও ডিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় জটিল মামলাগুলো তদন্তের স্বার্থে আসামিদের আটকের কথা কিছুদিন গোপন রাখা হয়।
এ রকম এক ঘটনার শিকার আজিমউদ্দীন নামে এক ব্যবসায়ী। তাঁকে গত ২২ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে কালো কাঁচের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় একদল লোক। তাঁর পরিবার ডিবি, র‌্যাব, সিআইডি কার্যালয়সহ নানা জায়গায় খোঁজ করেন। কোনো সন্ধান না পেয়ে ২ ফেব্রুয়ারি ভাটারা থানায় একটি অপহরণের মামলা করেন ওই ব্যবসায়ীর স্বজনেরা। কিন্তু পুলিশ ওই ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে পারেনি। ধরে নেওয়ার ৮১ দিন পরে আজিমউদ্দীনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ছয় হাজার জাল টাকাসহ মোহাম্মদপুর থানায় হস্তান্তর করে র‌্যাব-২। তাঁর বিরুদ্ধে জাল টাকা রাখার অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়।
আজিমউদ্দীনের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ বলেন, গত বছরের ৮ অক্টোবর আজিমউদ্দীনের স্ত্রী সুমাইয়া আক্তারের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সুমাইয়ার ভাই আরিফুর রহমান বাদী হয়ে আজিমউদ্দীনকে আসামি করে মোহাম্মদপুর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
আবুল কালামের দাবি, বনিবনা না হওয়ায় বিয়ের দুই মাস পরেই সুমাইয়া আত্মহত্যা করেন। কিন্তু আজিমউদ্দীনের শ্বশুরপক্ষের লোকেরা এর পর থেকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছিলেন। নিহত সুমাইয়ার এক চাচাতো ভাই একসময় র্যা বে চাকরি করতেন। তাঁর প্রভাবে আজিমউদ্দীনকে ধরে নিয়ে ৮১ দিন আটকে রেখে নির্যাতন করে র‌্যাব।
আজিমউদ্দীনকে অপহরণের মামলা ও তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া হত্যা মামলা, দুটিই তদন্ত করছে ডিবি। আর র্যা বের করা বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলাটি তদন্ত করছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ।
গত ২৮ এপ্রিল ভোরে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রাম থেকে কামাল হোসেন ও মরচী গ্রামের আবু বকরকে তাঁদের বাড়ি থেকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে তাঁদের স্বজনেরা অভিযোগ করেন। এরপর ৩০ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরায় র‌্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আরও ছয় ব্যক্তির সঙ্গে এই দুজনকে হাজির করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব দাবি করে, এঁরা ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায় প্রিজন ভ্যান থেকে জেএমবির তিন নেতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত। কামাল হোসেন ওই ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
ওই আটজনের মধ্যে ইউসুফ আলীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ২০ এপ্রিল ভোররাতে। তাঁর পরিবার ওই দিন দুপুরে ভালুকা থানায় জিডি করে। ইলিয়াসউদ্দীনকে ২১ এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টার দিকে ময়মনসিংহ শহরের গোলপুকুর পাড় এলাকা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে থাকা সহকর্মী হায়দার আলী পরে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানায় অপহরণ মামলা করেন। জিডি-মামলা হলেও ৩০ এপ্রিলের আগ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো বাহিনী এঁদের আটকের কথা স্বীকার করেনি।
অপহৃত এসব ব্যক্তি কীভাবে র‌্যাব হেফাজতে এলেন বা তাঁদের কোথা থেকে কখন গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সে বিষয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনে কিছু জানানো হয়নি।
বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি তানভীর রহমান ২০১২ সালের ১ অক্টোবর নিখোঁজ হন। পরিবারের লোকজন পুলিশ-র্যা বের কাছে খুঁজে না পেয়ে থানায় জিডিও করেন। সাত দিন পর ৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে জানা গেল তানভীরকে সাগর-রুনি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যা বের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান দাবি করেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ রকম কথা বলা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা টের পেয়ে অপরাধীরা আত্মগোপনে যাচ্ছেন, তখন স্বজনেরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপহরণের অভিযোগ তুলছেন। তিনি বলেন, ভুয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অপহরণের সংখ্যাও কম নয়। এমন কয়েকটি ঘটনা র‌্যাব উদ্ঘাটনও করেছে।
তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, একজন আসামিকে গ্রেপ্তারের পরে অনেক সময় মামলার আলামত বা তাঁর সহযোগীদেরও গ্রেপ্তারের সুযোগ তৈরি হয়। এ রকম ক্ষেত্রে আসামিদের আটকের কথা কিছুদিন গোপন রাখা হয়। এসব ক্ষেত্রে আদালতে উপস্থাপন করা কাগজপত্রে গ্রেপ্তারের দিন-তারিখ অসত্য লেখা হয় বলেও এই কর্মকর্তা স্বীকার করেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৩(২) ধারায় বলা আছে, গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া তাঁকে অতিরিক্ত সময় আটক রাখা যাবে না। ফৌজদারি কার্যবিধি ও পুলিশ প্রবিধানেও একই কথা বলা আছে। তবে তা মানছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে এভাবে ঢালাও বলা যাবে না। প্রত্যেকটা ঘটনা আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকেই তদন্ত হয় এবং প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়। তিনি বলেন, পুলিশের ওপর অর্পিত দায়িত্ব আইনি বাধ্যবাধকতার ভেতরে থেকেই সম্পন্ন করে পুলিশ।