চিরনিদ্রায় জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি

নিজের সৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। ২০০৬ সালের ৬ মার্চ ছবিটি তোলেন জাহিদুল করিম
নিজের সৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। ২০০৬ সালের ৬ মার্চ ছবিটি তোলেন জাহিদুল করিম

তিনি চলে গেলেন। রেখে গেলেন এমন এক কীর্তি, যা বাঙালির স্মরণে চিরজাগরূক থাকবে। তিনি স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মহান স্বাধীনতার স্মারক যে সৌধটি মাথা উঁচু করে আছে সাভারে, সেই জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি তিনি।
দীর্ঘদিন রোগভোগের পর গতকাল সোমবার বেলা আড়াইটায় তিনি রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তিনি দুই মেয়ে, মা ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন দীর্ঘদিন থেকে ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। সাধারণত তাঁর শান্তিনগরের বাড়ি থেকে বের হতেন না। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় গত রোববার বেলা ১১টায় তাঁকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে হেমন্তের অপরাহ্নে তিনি চিরনিদ্রায় ঢলে পড়েন।
বিকেল সাড়ে তিনটায় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক আবদুল্লাহ আল শাফি মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, রোববার অচেতন অবস্থায় স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনকে হাসপাতালে আনা হয়। তাঁর চিকিৎসার জন্য দ্রুত একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে চিকিৎসা শুরু করা হয়। প্রথম পর্যায়ে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও বিকেল থেকে অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। চিকিৎসকেরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও আর তাঁর অবস্থা ফেরাতে পারেননি।
গতকাল রাতে মাইনুল হোসেনের ফুফাতো ভাই কাজী আবদুল নঈম প্রথম আলোকে জানান, হাসপাতাল থেকে মরদেহ বিকেলে আল-মারকাজুল ইসলামের ব্যবস্থাপনায় গোসল ও কাফন করা হয়। এরপর কিছু সময়ের জন্য শান্তিনগরের বাড়িতে এনে রাখা হয়। এখানে পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও সুহৃদরা তাঁকে শেষ দেখা দেখতে আসেন। এরপর মরদেহ রাখা হয় বারডেমের হিমঘরে। তাঁর বড় মেয়ে ও বোন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। মৃত্যুর খবর পেয়ে গতকালই তাঁরা দেশে রওনা হয়েছেন। তাঁরা আসার পর দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জীবন ও কর্ম: স্থপতি মাইনুল হোসেনের জন্ম ১৯৫১ সালের ১৭ মার্চ, মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে। তাঁর বাবা সৈয়দ মুজিবুল হক যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। দাদা সৈয়দ এমদাদ আলী ও নানা গোলাম মোস্তফা বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি। তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি নেন।
স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন জাতীয় স্মৃতিসৌধ ছাড়াও ১৯৭৬-৯৮ সালের মধ্যে বেশ কিছু বড় স্থাপত্যকর্ম করেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে কারওয়ান বাজারের আইআরডিপি ভবন, ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, চট্টগ্রাম ইপিজেড, ঢাকার অ্যাডভোকেট বার কাউন্সিল ইত্যাদি।
মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাভারে স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নকশা আহ্বান করা হয় ১৯৭৮ সালে। মোট ৫৭টি নকশার মধ্যে থেকে সে সময়ের তরুণ স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনের নকশাটি গৃহীত হয়। নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৮৮ সালে।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ সাতটি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজাকৃতির স্তম্ভের সমন্বয়ে নির্মিত। এটি ১৫০ ফটু উঁচু। এই সাতটি স্তম্ভ বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সাতটি পর্যায়ের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত। পর্যায়গুলো হলো ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬-এর শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ।
শোক: জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে পৃথক শোকবাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তাঁরা বলেছেন, এই বরেণ্য স্থপতির স্মৃতি অমর হয়ে থাকবে। তাঁরা মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন।
এ ছাড়া শোক প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সংস্কৃতিসচিব রণজিৎ কুমার বিশ্বাস।