'নির্বাচনী অনিয়ম খোলাসা' করলেন এইচ টি ইমাম!

৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রশাসনে দলীয় সমর্থকদের ভূমিকা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বক্তব্যে খোদ শাসক দল আওয়ামী লীগ এবং সরকারের ভেতর ও বাইরে তোলপাড় চলছে। তাঁর বক্তব্যে দলের নেতা ও সরকারের মন্ত্রীরা বিব্রত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সমালোচকেরা বলছেন, তাঁর বক্তব্যে নির্বাচনী অনিয়ম খোলামেলাভাবে প্রকাশ পেয়েছে এবং তা বিরোধীদের অভিযোগকেই সমর্থন করছে।
দলীয় নেতাদের অনেকে মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দল ও সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় তাঁকে পদ থেকে অপসারণ করা উচিত। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হওয়ার মতো তাঁর রাজনৈতিক যোগ্যতা নেই। সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মতোই তিনি দল ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছেন বলে তাঁরা মনে করছেন।
গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) ছাত্রলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এইচ টি ইমাম ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে বলেছেন, ‘নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ পুলিশ ও প্রশাসনের যে ভূমিকা; নির্বাচনের সময় আমি তো প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলেছি, সব জায়গায় আমাদের যারা রিক্রুটেড, তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদেরকে দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, বুক পেতে দিয়েছে।’ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। তার পরে আমরা দেখব।’
গতকাল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী, সম্পাদকমণ্ডলী ও উপদেষ্টামণ্ডলীর বেশ কয়েকজন নেতা প্রথম আলোর কাছে এইচ টি ইমামের এসব বক্তব্যের বিষয়ে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানান। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন মন্ত্রীও রয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁদের করণীয় সম্পর্কে অনেকে টেলিফোনে নিজেদের মধ্যে কথাও বলেছেন বলে জানা গেছে।
তবে এইচ টি ইমাম প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হওয়ায় নেতা ও মন্ত্রীরা সংবাদপত্রে উদ্ধৃত হতে চাননি। তাঁরা জানান, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন। বিরোধী দল এত দিন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও প্রশাসনে দলীয়করণ নিয়ে যে অভিযোগ করত, এইচটি ইমামের বক্তব্যে সেই অভিযোগের যথার্থতাই তুলে ধরা হয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন।
এইচ টি ইমামের বক্তব্যে আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলোর মধ্যেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেধার ভিত্তিতেই বিসিএস পরীক্ষায় প্রার্থী নির্বাচন করা হয়। মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে উনি (এইচ টি ইমাম) যা বলেছেন, তা অবান্তর।’ রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘নির্বাচন সম্পর্কে তাঁর যে বক্তব্য, সে অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। নির্বাচনের সময় যে আক্রমণ হয়েছে, তা দমনের বিষয়টি প্রশাসনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এটা অতিরিক্ত কিছু নয়।’
আওয়ামী লীগের অপর শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ এইচ টি ইমামের বক্তব্য সম্পর্কে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে তিনি বলেন, ‘কেন উনি এটা বলেছেন, তা তাঁকেই জিজ্ঞাসা করুন।’
অবশ্য এইচ টি ইমামের সঙ্গে গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী ও উপদেষ্টামণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য মনে করেন, এইচ টি ইমাম প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা তাঁর পদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি দল ও সরকারের ক্ষতি করেছেন এবং ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছেন। সরকার আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে বলেই তিনি এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার সাহস পেয়েছেন বলে তাঁদের ধারণা। কারও কারও মতে, লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যের চেয়েও এইচ টি ইমামের বক্তব্য ভয়ংকর। তাঁর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে তাঁরা মত দেন।
দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও একজন জ্যেষ্ঠ সাংসদ প্রথম আলোকে বলেন, এইচ টি ইমামের এ বক্তব্য অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। সরকারকে রক্ষা করতেই তাঁকে পদ থেকে সরানো জরুরি।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য মনে করেন, জনসমর্থন না থাকলে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে কোনো সরকার টিকে থাকতে পারে না, বা কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যেতে পারে না। তাঁরা মনে করেন, এইচ টি ইমাম অরাজনৈতিক ব্যক্তি বলেই এ রকম বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে বিরোধী দলের অভিযোগ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা পেয়েছে।
দলের উচ্চপর্যায়ের কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংসদ এইচ টি ইমামের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সংসদে বক্তব্য দেওয়ার ব্যাপারে গতকাল নিজেরা আলোচনা করেন। একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীও এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখান। পরে বিষয়টি নিয়ে আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত হয়। একজন সাংসদ জানান, কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হলে দু-তিন দিন পর হলেও এ ব্যাপারে সংসদে আলোচনা উঠতে পারে।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এ বক্তব্য এইচ টি ইমামের ব্যক্তিগত, নাকি সরকারের বা দলের, তা পরিষ্কার করতে হবে। তা না হলে জনগণের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির আশঙ্কা থাকবে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এইচ টি ইমামের বক্তব্যের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের মতামত নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করা হলে একজন কমিশনার ভিন্নমত প্রকাশ করেন। নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বলেন, নির্বাচন পরিচালনা করেছে নির্বাচন কমিশন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের আওতায় কাজ করেছে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে তাঁর (এইচ টি ইমাম) সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করিনি।’
তবে যোগাযোগ করা হলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন নিয়ে মানুষের ধারণা এত দিন অনুমাননির্ভর ছিল। এখন এইচ টি ইমাম তা খোলাসা করে দিয়েছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা যে পক্ষপাতমূলক ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে। এটা নির্বাচন কমিশনের জন্য লজ্জাকর। এ ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের যোগ্যতা ও ভাবমূর্তি উভয়েই প্রচণ্ডভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বলে-কয়ে যে নির্বাচনী অনিয়ম করা হয়েছে, এটি তাঁর বক্তব্যে প্রমাণিত হয়েছে। আর নিয়োগ নিয়ে তাঁর বক্তব্য অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক। এ ধরনের বক্তব্য গণতন্ত্রের জন্য অশুভ ইঙ্গিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, নির্বাচনে পক্ষপাতমূলক প্রশাসনের আশঙ্কা যে অনেকে করে থাকেন, তা উনি প্রকাশ করে দিলেন। তাঁর এ বিতর্কিত মন্তব্য আইনের শাসনের প্রতি বড় ধাক্কা।