ঢাকা পথচারীবান্ধব নয়

ফার্মগেট থেকে শেরাটন হোটেল পর্যন্ত যত্রতত্র রাস্তা পারাপার বন্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে ডিএমপি। গতকাল কারওয়ান বাজার এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান l ছবি: প্রথম আলো
ফার্মগেট থেকে শেরাটন হোটেল পর্যন্ত যত্রতত্র রাস্তা পারাপার বন্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে ডিএমপি। গতকাল কারওয়ান বাজার এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান l ছবি: প্রথম আলো

রাজধানী ঢাকার পথ পথচারীবান্ধব নয়। অবকাঠামোগত যেসব ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলোর কোনোটাই প্রকৌশলগত বা নগরবাসীর ব্যবহারের সঙ্গে মানানসই নয়। অথচ আন্তর্জাতিক রীতি মেনে সরকারের পরিবহন নীতিমালায় পথচারীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগর যাতায়াতব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে হলে তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এগুলো হচ্ছে: প্রকৌশলগত সঠিকতা নিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ। অবকাঠামো ব্যবহার ও এ-সংক্রান্ত আইন সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষিত করা এবং সবশেষ ব্যবস্থা হচ্ছে আইন প্রয়োগ।
ঢাকা মহানগর পুলিশ অবকাঠামোগত সুবিধা ও পথচারীদের শিক্ষিত না করেই তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের এই অভিযান পথচারীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতির পরিপন্থী। দীর্ঘ মেয়াদে এর কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।
প্রকৌশল ও নগর পরিকল্পনা-মতে, পথচারীদের সড়ক ব্যবহারের দুটি রীতি হচ্ছে সময় ও পথ আলাদা করে দেওয়া। সময় আলাদা করে দেওয়ার পদ্ধতি হলো, সড়কের মোড়গুলোতে জেব্রা ক্রসিং করে দিয়ে মানুষের পারাপারের জন্য কিছু সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া।
ঢাকা নগর পরিবহন পরিকল্পনা (ডিইউটিপি) প্রকল্পের অধীনে রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে সংকেত বাতির খুঁটিতে মানুষের চিহ্ন রেখে সময় আলাদা করা হয়েছিল। লাল মানুষের চিহ্ন থাকলে পথচারী পারাপার বন্ধ এবং সবুজ হলে পথচারী চলবে—এই ব্যবস্থা থাকলেও এখন তা কার্যকর নেই। ট্রাফিক পুলিশ হাত ইশারায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে আর পথচারী চলে ফাঁকে ফাঁকে।
পথ আলাদা করে দেওয়া হলো, পদচারী সেতু (ফুটওভারব্রিজ) ও পাতালপথ (আন্ডারপাস) ব্যবহার। ঢাকার পদচারী সেতুর বেশির ভাগই ব্যবহার উপযোগী নয়। অনেকগুলোই সঠিক স্থানে নির্মাণ করা হয়নি।

.
.

ঢাকার পরিবহনব্যবস্থা নিয়ে ২০১০ সালে একটি সমীক্ষা করে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা। এতে বলা হয়েছে, ঢাকায় প্রতিদিন দুই কোটিরও বেশি যাতায়াত হয়। এর প্রায় ২০ শতাংশ হয় হেঁটে। আর শূন্য থেকে আড়াই কিলোমিটারের মধ্যে হওয়া যাতায়াতের ৩০ শতাংশই হয় হেঁটে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মিলি বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের অভিযান মূলত জনসচেতনতার উদ্দেশ্যে, এটা প্রতীকী কর্মসূচি। কারণ, চলতি বছর এ পর্যন্ত ঢাকায় ১৩৪ জন পথচারি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। প্রকৌশলগত ও সংকেত ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা আছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে নয়টি সরকারি সংস্থা কাজ করে। এসব বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা হয়, পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ফোরামে পরামর্শও দেওয়া হয়।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এর চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন মনে করেন, অভিযান চলার পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম চালানো দরকার।
আইন কী বলে: ২০১৩ সালে করা জাতীয় সমন্বিত বহুমাধ্যমভিত্তিক পরিবহন নীতিমালায় ‘পথচারীদের অগ্রাধিকার’ দিয়েছে সরকার।
নীতিমালায় করণীয় ঠিক করা হয়েছে—ফুটপাত দখলমুক্ত করা; প্রশস্ত ফুটপাত ও পথচারীবান্ধব সড়ক নির্মাণ; ফুটপাতের উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা; শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য ফুটপাতে ঢালু পথ নির্মাণ; নিরাপদ পথ পারাপারে পথচারীদের সুরক্ষা; ট্রাফিক সংকেত বণ্টনে পথচারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া।
প্রথম দিনে ৩৩১ পথচারীকে জরিমানা
২০১১ সালে ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার ৪৪ শতাংশ সড়কে ফুটপাতই নেই। বিদ্যমান ফুটপাতের ৮২ শতাংশেরই অবস্থা করুণ। ৩১ শতাংশ ব্যবহারকারী বলেছেন, তাঁরা হাঁটতে গিয়ে আহত হয়েছেন।
মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩-তে পথচারী পারাপারের স্থানের কাছে এসে প্রতিটি চালককে বাধ্যতামূলক থামতে বলা হয়েছে। সরকার মোটরযান অধ্যাদেশ সময়োপযোগী করার উদ্যোগ নিয়ে একটা খসড়া তৈরি করেছে। এতেও পথচারী চলাচলের স্থানে এসে চালকের থামার কথা বলা হয়েছে। আর পথচারীদের বলা হয়েছে জেব্রা ক্রসিং, পাতালপথ ও পদচারী সেতু ধরে চলতে। তবে তা প্রতি ৩০০ মিটারের মধ্যে থাকতে হবে এবং ব্যবহারবান্ধব হতে হবে। এই আইন না মানলে শাস্তি কী, তা বলা নেই।
বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সারওয়ার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, পথচারী নয়, আগে যানবাহন চলাচল ঠিক করতে হবে। যেখানে-সেখানে যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাখা ও যাত্রী ওঠানামা বন্ধ করতে হবে। তাঁর মতে, পথচারীবান্ধব পারাপারের ব্যবস্থা করলে জোর করতে হবে না। তাঁরা নিজ গরজেই নিরাপদ পথ ধরে চলবে। অনেক দেশেই পদচারি সেতু নেই। সেখানে তো পথচারী পার হচ্ছেন এবং দুর্ঘটনার হারও কম।

শাহবাগ থেকে সার্ক ফোয়ারা: শাহবাগে সড়ক চারদিকে। কিন্তু সেখানে পদচারী সেতু আছে দুটি। একটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বারডেম হাসপাতালের মধ্যে। অন্যটি শিশুপার্কের কাছাকাছি। বারডেম ও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পদচারী সেতুটি মানুষ চলাচলের পথেই আছে এবং এর ব্যবহারও বেশি। কিন্তু শিশুপার্কের পাশেরটি ব্যবহার কম। কারণ, বেশির ভাগ মানুষ পারাপার হয় জাদুঘরের সামনের রাস্তা থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল ও বারডেমের দিকে। আর শাহবাগ মোড়ে সংকেত বাতির খুঁটিতে পথচারী পারাপারের যে নির্দেশনা আছে, সেটিও অকার্যকর।
বাংলামোটরে একটি পদচারী সেতু থাকলেও সার্ক ফোয়ারায় নেই। অথচ যান ও মানুষ চলে চারদিকে। দুই মোড়েই সংকেত ব্যবস্থার মাধ্যমে পথচারীদের জন্য সময় আলাদা করে দেওয়ার যে ব্যবস্থা, সেটি অকার্যকর।

এ ছাড়া সার্ক ফোয়ারা মোড়ে লোহা ও শিটের সাহায্যে বেড়া দিয়ে পথচারীদের পথ রোধ করা হয়েছে। মানুষ পারাপারের স্থানের পাশে পুলিশ বক্স বসানো হয়েছে, যা পথচারী ও চালকদের দৃষ্টিসীমা সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। জেব্রা ক্রসিংয়ের যে অংশ দিয়ে পথচারী পারাপার হওয়ার কথা, সেখান দিয়ে গাড়ি চলে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনের জেব্রা ক্রসিং এর বড় উদাহরণ।
নগর পরিবহন নিয়ে কাজ করা নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সাঈদ রানা শাহবাগ থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ফুটপাত ও পদচারী সেতুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে প্রথম আলোকে বলেন, ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের পাশের পদচারী সেতুটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। ডেইলি স্টার সেন্টারের পাশেরটির দুটি সিঁড়ি অচল। পরিবাগে সেতুর কারণে ফুটপাত দিয়ে মানুষ হাঁটতে পারে না। ফার্মগেট থেকে পশ্চিম পাশের ফুটপাত ধরে সার্ক ফোয়ারা আসতে পাঁচটি ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল পার হতে হয়। পূর্ব পাশ ধরে গেলে তিন স্থানে ময়লা-আবর্জনা, দুই স্থানে সরু পথ এবং তিন স্থানে ফুটপাত দখল করে রিকশা-ভ্যান রাখা। এ অবস্থায় পুলিশের অভিযান এই নগরে পথচারীদের নিষিদ্ধ করার মতোই কাণ্ড।
গাড়ির জন্যই সব: মেয়র হানিফ ও মৌচাক-মগবাজার-সাতরাস্তা উড়ালসড়ক নির্মাণকাজের জন্য যাত্রাবাড়ী, মগবাজারের পদচারী সেতু ভেঙে ফেলা হয়। মৌচাকের পদচারী সেতুটিও ভেঙে ফেলা হবে। কুড়িল উড়ালসড়ক নির্মাণের পর সেখানে দুটি পদচারী সেতুর কাঠামো তৈরি করা হয়। কিন্তু তাতে কোনো পাটাতন নেই। ফলে পথচারীরা দ্রুতগতির গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আড়াআড়ি সড়ক পার হন। গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ওই এলাকায় ৩৫ জন পথচারী সড়ক ও রেললাইন পার হতে গিয়ে মারা গেছেন।
এ বিষয়ে অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, যাত্রাবাড়ী ও মগবাজারে আর পদচারী সেতু বসানোর সুযোগ নেই। সরকার যানবাহন চলাচল নিরবচ্ছিন্ন করতে গিয়ে পথচারীদের চলাচল কঠিন করে ফেলেছে। অথচ এই দুই স্থানে ‘ফুল’ আকৃতির অর্থাৎ চারদিকে চলাচলের পদচারী সেতু ছিল। জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি এমন শহরে এই পদ্ধতির পদচারী সেতু খুবই জনপ্রিয়।