লালপুরে ১২ বিদ্যালয়ের ৪৫ ভুয়া শিক্ষক এমপিওভুক্ত!

নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার ১২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৪৫ জন ভুয়া শিক্ষকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সব ধাপে জাল কাগজ তৈরি করে তাঁরা বেতনের সরকারি অংশ (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার-এমপিও) তুলে নিচ্ছেন। এই দুর্নীতির কারণে বছরে সরকারের ৪১ লাখ টাকা অপচয় হচ্ছে। 
ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে দুটি বিদ্যালয়ে তদন্ত হয়েছে। রাজশাহী দুর্নীতি দমন কমিশনও একটি বিদ্যালয়ে তদন্ত করছে।
গত বছরের জুলাই মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানতে পারে যে লালপুর উপজেলায় অবস্থিত কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা এমপিওভুক্ত হয়েছেন। এই বিদ্যালয়গুলোর ভুয়া কার্যবিবরণী দেখিয়ে, জাল সইয়ে ভুয়া নিয়োগপত্র তৈরি করে এমনকি ভুয়া নিবন্ধন উল্লেখ করে শিক্ষক নিয়োগ দেখানো হয়েছে। এমনও বিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে প্রধান শিক্ষক কিছু না জানলেও এমপিওতে নতুন শিক্ষকের নাম চলে এসেছে। পরে প্রভাব খাটিয়ে তাঁরা বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে প্রধান শিক্ষককে বেতন বিলে সই করতে বাধ্য করেছেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষক বিষয়টি জেনেই সই করেছেন। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।
অভিযুক্ত বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে উপজেলার দুয়ারিয়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, আড়বাব নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঢুষপাড়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, রহিমপুর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, রাক্সা উচ্চবিদ্যালয়, বিলমাড়িয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, লালপুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, কলসনগর উচ্চবিদ্যালয়, লালপুর থানা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, দুরদুরিয়া মদিনাতুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা, ভেল্লাবাড়িয়া ওয়াহেদ উচ্চবিদ্যালয় ও বড়বড়িয়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়।
অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের ফলাফলশিট, রেজুলেশন খাতা, নিয়োগ পরীক্ষার খাতা ও নোটিশ বইতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সই জাল করা হয়েছে। ওই শিক্ষক নিয়োগে জাল সনদ, জাল নিবন্ধনপত্র ও জাল ইনডেক্স নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, এসব বিদ্যালয়ে এ রকম ভুয়া শিক্ষকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫ জন। এর মধ্যে লালপুর থানা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের আটজন শিক্ষক ছাড়া সবাই বেতন নিচ্ছেন। বছরে তাঁদের উত্তোলিত বেতনের পরিমাণ ৪০ লাখ ৯৫ হাজার ১২০ টাকা। এ ছাড়াও তাঁরা বছরে দুটি উৎসব ভাতাও পাচ্ছেন।
১২ নভেম্বর লালপুর উপজেলার আড়বাব নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে তাদের কাগজপত্রে ১৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। অথচ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে তাদের পাঁচজন শিক্ষক ও দুজন কর্মচারী থাকার কথা। বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ৪০ জন করে এবং নবম শ্রেণিতে ২০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত পাওয়া যায়। অষ্টম ও দশম শ্রেণির কোনো শিক্ষার্থী পাওয়া যায়নি। শিক্ষকেরা জানান, জেএসসি পরীক্ষার কারণে অষ্টম শ্রেণি ও কোর্স শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে নেই। অতিরিক্ত শিক্ষকের বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা জানান, এটা প্রধান শিক্ষক বলতে পারবেন। তবে ওই দিন অতিরিক্ত শিক্ষকদের কাউকেই বিদ্যালয়ে পাওয়া যায়নি। শিক্ষকেরা জানান, তাঁরা পরীক্ষার ডিউটি করতে গেছেন।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রধান শিক্ষক খাইরুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে ওই শিক্ষকেরা তাঁকে দিয়ে জোর করে কাগজপত্রে সই নিয়েছেন।
দুয়ারিয়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ১৫ জন ভুয়া শিক্ষক রয়েছেন। ওই বিদ্যালয়েও প্রধান শিক্ষক ছিলেন না। অন্য শিক্ষকেরা এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। শিক্ষকদের এমপিওর কপি দেখতে চাইলে তাঁরা বলেন, প্রধান শিক্ষক তালা দিয়ে চলে গেছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখতে চাইলে তাঁরা বলেন, টিফিন দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীরা অনেকেই বাসায় গেছে।
লালপুর উপজেলা সদরে এসে প্রধান শিক্ষক মঞ্জুর রহমানকে পাওয়া যায়। তিনি লালপুর থানা আওয়ামী লীগের পরিবেশ ও বনবিষয়ক সম্পাদক বলেও পরিচয় দেন। নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে তাঁর বিদ্যালয়ে সাতজন শিক্ষক-কর্মচারী থাকার কথা। কিন্তু তিনি ১৯ জনের কথা স্বীকার করেন। তিনটা শাখা দেখানোর কারণে তিনজন শিক্ষক তিনি বেশি পেয়েছেন বলে দাবি করেন। কীভাবে অতিরিক্ত ব্যক্তিদের বেতন করলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সারা বাংলাদেশে যেভাবে হচ্ছে তিনিও সেভাবে করেছেন।
লালপুর থানা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে জেএসসি পরীক্ষার কারণে ক্লাস বন্ধ ছিল। প্রধান শিক্ষক শরীফা বেগম বলেন, গত বছর নভেম্বরের এমপিওতে হঠাৎ করেই তিনজন অতিরিক্ত শিক্ষকের নাম চলে এসেছে। পরের এমপিওতে আরও পাঁচজন অতিরিক্ত শিক্ষকের নাম এসেছে। এখন তাঁরা বিভিন্নভাবে বেতন ওঠানোর জন্য তাঁকে চাপ দিচ্ছেন। গত ২৬ মে মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের রাজশাহী কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ওয়াজেদ আলী গাজী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আটজন ভুয়া শিক্ষকের প্রমাণ পেয়েছেন।
এ ব্যাপারে লালপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দুলাল আলম বলেন, তাঁর স্বাক্ষর জাল করে নিয়োগের কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, তাঁর স্বাক্ষর অন্য জায়গা থেকে স্ক্যান করে তাদের কাগজপত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত লালপুর থানা বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলসনগর উচ্চবিদ্যালয়ে তদন্ত হয়েছে বলেও জানান তিনি।