স্বপ্নদিশারি স্কুল

ছবি তোলার কথা বলতেই নিজেদের মতো করে বসে গেল মৌলভীবাজারের ব্লুমিং রোজেস অটিস্টিক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুবিদ্যালয়ের এই শিশুরা l ছবি: প্রথম আলো
ছবি তোলার কথা বলতেই নিজেদের মতো করে বসে গেল মৌলভীবাজারের ব্লুমিং রোজেস অটিস্টিক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুবিদ্যালয়ের এই শিশুরা l ছবি: প্রথম আলো

বাসার একটি কক্ষে শুরু সেই উদ্যোগের। এখন সেটাই কারও কারও আশার আলোর সলতে। শারীরিকভাবে অক্ষম সন্তান নিয়ে হতাশায় ডুবে থাকা অভিভাবকদের স্বপ্নের দিশারি। একজনের উদ্যোগ আর আরেকজনের বাড়িয়ে দেওয়া হাতে গড়ে ওঠা এই স্বপ্নদিশারি ‘ব্লুমিং রোজেস অটিস্টিক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু বিদ্যালয়’।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলা পরিষদ কার্যালয়সংলগ্ন এই স্কুল। স্কুলটিতে ঢুকেই তৈরি হয় ভালো লাগার এক অনুভূতি। চারদেয়ালের ভেতর নানা রকমের গাছপালা আর মৌসুমি ফল ও সবজির বাগান। এক পাশে টিনের ছাউনির পাকা ভবন। তিনটি কক্ষে চলছে বিভিন্ন বয়সী প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিচর্যা। কারও চলছে বর্ণমালার পাঠদান, কারও শরীরচর্চা। আবার কারও সামনে মেলে রাখা হয়েছে বর্ণিল খেলার সরঞ্জাম। বারান্দার এক পাশে দাঁড়ানো শিশুদের স্বপ্নকাতর মায়েরা।
একটি বেসরকারি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডি ডি রায় বাবলু এ স্কুলের উদ্যোক্তা। গত বুধবার তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে (দেবব্রত রায়, বয়স ১২) একজন অটিস্টিক। তাকে অনেক জায়গায় দেখালাম। উঠতে-বসতে পারে না। পরে ভারতে নিয়ে গেছি। সেখানকার চিকিৎসক বললেন আমাকে প্রশিক্ষণ নিতে।’
পরে চিকিৎসকের কথামতো অটিজমের ওপর ভারতের কলকাতা, দিল্লি ও বেঙ্গালুরুতে ৯২ দিনের প্রশিক্ষণ নেন বাবলু। দেশে ফিরে লেগে গেলেন সন্তানের পরিচর্যায়। তিন মাসের মাথায় ফলও পেলেন। সবকিছুতেই সে সাড়া দিতে লাগল।
২০০৬ সালের কথা এটা। সন্তানের পরিচর্যা করার একপর্যায়ে বাবলুর মনে হলো, সন্তানের পাশাপাশি একই সময় ও খানিকটা বাড়তি শ্রমে এমন আরও কিছু শিশুরও তো পরিচর্যা করা সম্ভব। এই ভাবনা থেকেই পরে মৌলভীবাজার শহরের কুসুমবাগ এলাকায় তাঁর বাসার একটি কক্ষে স্কুল খোলা। চার-পাঁচজন অটিস্টিক শিশুকে দিয়ে শুরু। এই শিশুরা একসময় ভালো করে উঠে দাঁড়াতে পারত না। কথায় সাড়া দিত না। এরাই এখন উঠে দাঁড়াচ্ছে, কথায় সাড়া দিচ্ছে।
বাবলু জানান, এ সাফল্যের কথা অনেক অভিভাবকই জেনে গেলেন। যেসব শিশুকে নিয়ে অভিভাবকেরা হতাশ ছিলেন, স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়েছিলেন, তাঁরাও পরে নিজেদের সন্তান নিয়ে এ স্কুলে এলেন। কিন্তু ছোট কক্ষটিতে ১১ জন শিশুর বেশি তাঁর পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
ছোট কক্ষ থেকে ভবনে: অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে সাফল্যের গাঁথা আর স্থান সংকুলান নিয়ে সীমাবদ্ধতার কথা বাবলুর কাছ থেকে একসময় জানতে পারেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আশরাফুল আলম খান। পরে এ উদ্যোগে পাশে এসে দাঁড়ান তিনি।
পরে ২০১২ সালে স্কুলটিকে নিয়ে আসা হয় বর্তমান ভবনটিতে। এরপর পরিচিতজন, বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ীসহ সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ টাকাপয়সা, খেলনা, আসবাব, বৈদ্যুতিক পাখা—যে যা পারেন নিয়ে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। কেউবা বিনা পারিশ্রমিকে চান শিক্ষক হতে। বর্তমান ভবনের মালিকও কম ভাড়া নিয়ে স্কুল চালিয়ে যেতে দিলেন। স্কুলে এখন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৭০। নিয়মিত উপস্থিত থাকে অন্তত ৩০ জন। বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ীদের আর্থিক সহায়তা এখনো অব্যাহত আছে।
শিক্ষা ও পরিচর্যা কার্যক্রম: স্কুলে সকাল ১০টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত অটিস্টিক এসব শিশুর চলে যোগব্যায়াম, যন্ত্রের সহায়তায় শরীরচর্চা, স্পিচ থেরাপি (কথা বলার চর্চা) ও প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা। তবে এ জন্য কোনো অভিভাবককে বেতন দিতে হয় না। উপরন্তু দরিদ্র শিশুদের জন্য দেওয়া হয় আর্থিক সাহায্য। এ ছাড়া শিক্ষক যাঁরা আছেন, তাঁরা নিরলস শ্রম দিচ্ছেন নামমাত্র পারিশ্রমিকে।
স্কুলের উদ্যোক্তা বাবলু বলেন, ‘বাচ্চাদের প্রতি ব্যক্তিগত সহমর্মিতা থেকে আমি প্রতিদিনই স্কুলে আসি। নিজেও ক্লাস নিই।’
শিক্ষক-অভিভাবকেরা যা বলেন: শিক্ষক ও অভিভাবক মাহফুজা ইয়াছমিন চৌধুরী বলেন, ‘এই স্কুল হওয়ায় কী যে উপকার হয়েছে, তা বলার মতো নয়। আমার শিশুটি আগে কিছুই করতে পারত না। এখন সে নিজের মতো চলতে পারে।’ অভিভাবক রেছনা বেগমের কথা, ‘আমার ছেলে শুরুতে হুইলচেয়ার ধরে উঠে দাঁড়াত। এখন চেয়ার নিতেই চায় না। একা একাই অনেকটা পথ হাঁটতে পারে।’
এগিয়ে যাওয়ার আশা: ইউএনও আশরাফুল আলম বলেন, ‘এখানে আসা শিশুরা জগৎ-বিচ্ছিন্ন ছিল। কাউকে দেখলে মুখ লুকোত। এখন সালাম দিচ্ছে। কথার উত্তর দিচ্ছে। শূন্য থেকে শুরু করেছি। স্বপ্ন অনেক বড়। জমির ব্যবস্থা হচ্ছে। সরকার থেকেও সাড়া মিলছে।’