বৈধভাবে বালু তোলা যাচ্ছে না অবৈধভাবে তুলছেন নেতারা

রাজশাহীতে পদ্মা নদী থেকে বালু তুলতে ২০০৯ সালে একটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছিল নৌ মন্ত্রণালয়। এ জন্য সরকারকে রাজস্বও দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। এরপর উচ্চ আদালত তাদের বালু উত্তোলনে বিঘ্ন সৃষ্টি না করার নির্দেশ দেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা এক মুঠো বালুও তুলতে পারেনি।

অথচ শুধু চারঘাট উপজেলার মুক্তারপুর ঘাট থেকেই প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ ট্রাক বালু অবৈধভাবে তুলছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। স্থানীয় প্রশাসন মামলা করলেও বালু তোলা বন্ধ হয়নি।

নথিপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল রাজশাহী নগরের মেসার্স বরেন্দ্র অ্যাসোসিয়েটস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে এক বছরে পদ্মা থেকে ২০ লাখ ঘনফুট বালু তোলার অনুমতি দেয়। অনুমতিপত্রে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি চারঘাটের মুক্তারপুর, গৌড়শহরপুর, মতিহার শ্যামপুর, পবা উপজেলার বসুড়ি, লবগঙ্গা ও হরিপুর; গোদাগাড়ী উপজেলার বারইপাড়া, শেখেরচর, এলাহী নগর, দক্ষিণ নির্মলচর, কাঁঠালপাড়া, ফরহাদপুর ও ডুমুরিয়া মৌজা থেকে ওই পরিমাণ বালু তুলতে পারবে।

প্রতিষ্ঠানটি রয়্যালটি বাবদ তিন লাখ টাকা, এর ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ৪৫ হাজার টাকা, আয়কর বাবদ ১৫ হাজার টাকা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাছে জমা দেয়। নিয়ম অনুযায়ী রাজস্বের একটি অংশ রাজশাহী জেলা প্রশাসন পাবে। কিন্তু পরের বছর বালুমহাল ইজারা দেওয়ার বিষয়টি ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে যাওয়ায় জেলা প্রশাসন আর তাদের অংশ জমা নেয়নি। এ অবস্থায় বরেন্দ্র অ্যাসোসিয়েটস হাইকোর্টে রিট আবেদন করে।

আদালত ২০০৯ সালের ৪ আগস্ট পদ্মা নদীগর্ভের হাইড্রোগ্রাফিক চার্ট অথবা নেভিগেশন চ্যানেলে বর্ণিত এলাকা থেকে বরেন্দ্র অ্যাসোসিয়েটসকে বালু উত্তোলনে বিঘ্ন সৃষ্টি না করার নির্দেশ দেন। এর পরও তৎকালীন জেলা প্রশাসক রাজস্ব জমা দেওয়ার অনুমতি দেয়নি। এদিকে আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক প্রতিষ্ঠানটি গত ২৫ জুলাই রাজশাহী জেলা প্রশাসকের অনুকূলে বালু খাতে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে মোট ছয় লাখ টাকার রাজস্ব জমা দেয়।

বরেন্দ্র অ্যাসোসিয়েটসের স্বত্বাধিকারী মাহফুজা মোরশেদ বলেন, অনুমতি পাওয়ার পর থেকে তাঁরা জেলা প্রশাসনের কাছে অন্তত ৫০ বার আবেদন করেছেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর তাঁদের ডেকেছেন, কাগজপত্র দেখেছেন কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর গত জুলাই মাসেও দুটি দরখাস্ত দিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, বালু তোলার বৈধ কাগজপত্র থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা বালুমহালের কাছে তাঁদের ভিড়তে দিচ্ছেন না। তাঁরা সরকারকে রাজস্ব দিয়ে শুধু কাগজপত্র নিয়ে ঘুরছেন।

সরেজমিনে ঘুরে মাহফুজার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। পদ্মার সব ঘাটেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বালু তুলতে দেখা গেছে। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, শুধু চারঘাটের মুক্তারপুর ঘাট থেকেই প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ ট্রাক বালু তোলা হচ্ছে। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন চারঘাট পৌর আওয়ামী লীগের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব। তাঁর সঙ্গে আছেন সোনা মিঞা, আবদুল হান্নান, সেকেন্দার আলী, বিপ্লব, তুষার, সাদ্দাক, শাহীনসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

অবৈধভাবে বালু তোলার অভিযোগে ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি চারঘাটের সদরহ ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক তাঁদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। একই অভিযোগে ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব-৫-এর তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক প্রফুল্ল কুমার সরকার আরেকটি মামলা করেন। এর পরও বালু তোলা বন্ধ না হওয়ায় গত ৩০ জানুয়ারি ভূমি কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক উত্তোলিত বালু জব্দ করেন এবং আরেকটি মামলা করেন। কিন্তু বালু তোলা বন্ধ হয়নি।

অনুমতি ছাড়াই বালু তোলার ব্যাপারে জানতে চাইলে আহসান হাবিব বলেন, তাঁরা এমনি কিছু কিছু করে বালু তোলেন। সব সময়ই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন এভাবে কিছু সুযোগ-সুবিধা পান।

চারঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘পুলিশ গেলে তারা পালিয়ে যায়। পুলিশ তো সারা দিন বালুঘাট পাহারা দিতে পারে না।’ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী জানান, বালু তুলতে আদালতের রায় নিয়ে এসে কেউ জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে তাঁর জানা নেই। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দেওয়ান মোহাম্মদ আবদুস সামাদ বলেন, আদালতের এসংক্রান্ত কোনো নির্দেশ তাঁদের হাতে পৌঁছায়নি। আদেশ পেলে অবশ্যই সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে তাঁরা আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।