পেরুয়াবাসীর স্বজন হারানোর দিন আজ

দিন-তারিখটা বেশ মনে আছে গীতা রায়ের (৬৫)। অগ্রহায়ণ মাসের ১৭ তারিখ, শনিবার। চাইলেই সেই বিভীষিকাময় দিনটির কথা ভুলতে পারবেন না। তাঁর স্বামী স্কুলশিক্ষক উপেন্দ্র চন্দ্র রায়কে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিল রাজাকাররা। অস্ত্রের মুখে অবুঝ তিন সন্তানকে নিয়ে সেদিন কাঁদতেও পারেননি তিনি।
এলাকার সুপরিচিত ভদ্র-বিনয়ী ‘উপেন মাস্টার’ শুধু নন, একই সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল আরও ২৫ জনকে। এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ধরে এনে পেরুয়া গ্রামের পাশে সুরমা নদীর তীরে একজন একজন করে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সকালে এই গণহত্যার ঘটনা ঘটে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার চরনারচর ইউনিয়নের পেরুয়া গ্রামে। ৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয়েছিল সুনামগঞ্জ। হাজারো মানুষ যখন জেলা শহর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলছিল, তখন জেলা শহর থেকে ৫৪ কিলোমিটার দূরের গ্রাম পেরুয়া জ্বলছিল দাউ দাউ করে। গ্রামের পাশের নদীতে লাশের সারি। রক্তে লাল নদীর জল। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে স্বজনহারাদের আর্তনাদে।
মরা সুরমা নদীর পূর্ব পাড়ে শাল্লা উপজেলার শ্যামারচর বাজার আর পশ্চিম পাড়ে দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রাম। গত বৃহস্পতিবার পেরুয়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় স্বজনহারা ও ঘটনার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে। কেউ বাবা, কেউ ভাই, কেউ মা, কেউ হারিয়েছেন স্বামীকে। কথা বলতে গিয়ে অনেকেরই চোখ ভিজে যায় জলে। গ্রামের কৃষিশ্রমিক ব্রজেন্দ্র দাসকেও (৭০) সেদিন নদীর তীরে হাত বেঁধে দাঁড় করানো হয়েছিল। গুলিও করা হয় তাঁকে লক্ষ্য করে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে নদীর জলে পড়ে বেঁচে যান তিনি। সেদিনের সেই ভয়াবহ ঘটনার ক্ষতচিহ্ন আজও তাঁর শরীরে বিঁধে আছে।
পেরুয়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী রামকুমারের ভাতিজা সুসেন চন্দ্র রায় চৌধুরী (৭০) তখন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে পড়েন। ৫ ডিসেম্বর রাতে সবাই মিলে ঘুমিয়েছেন। ভোরের দিকে গুলির শব্দ শুনে তাঁদের ঘুম ভাঙে। পাশের বাজার থেকে ছুটে আসছে গুলি। এরপর বাড়ির নারী-শিশুদের নিয়ে সুসেনরা দুই কিলোমিটার দূরে এলংজুড়ি গ্রামের পাশে গাছগাছালিঘেরা এক জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নেন। গ্রামের অন্যরাও সেখানে যান। বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে রাজাকাররা। একসময় ওই জায়গায় গিয়ে হাজির হয় রাজাকারের দল। সেখান থেকে পুরুষদের ধরে নিয়ে আসা হয় শ্যামারচর রামচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে। মাঠ থেকে সবাইকে নদীর ঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। কথা বলতে গিয়ে বারবার গলা ধরে আসছিল অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক সুধীর রঞ্জন রায়ের (৬৯)।
সেদিন গণহত্যায় শ্যামারচর রামচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রামকুমার রায়, তাঁর ছোট ভাই পল্লি চিকিৎসক রামানন্দ রায়, ছেলে চিত্তরঞ্জন রায়, ভাতিজা সমর চন্দ্র রায়, ঝন্টু চন্দ্র রায় প্রাণ হারান। রামকুমার রায়ের স্ত্রী কনক লতা রায় রাজাকারদের গুলিতে আহত হয়েছিলেন। তাঁর মুখে গুলি লেগেছিল। একসময় মুখে পচন ধরে। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ছয় মাস পর তিনি মারা যান।