বড় বনে বড় বিপর্যয়

ডুবে যাওয়া ট্যাংকার ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ উদ্ধার করে রাখা হয়েছে শ্যালা নদীর জয়মনিঘোল এলাকায়। গতকাল দুপুরে ছবিটি তুলেছেন এহসান-উদ-দৌলা
ডুবে যাওয়া ট্যাংকার ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ উদ্ধার করে রাখা হয়েছে শ্যালা নদীর জয়মনিঘোল এলাকায়। গতকাল দুপুরে ছবিটি তুলেছেন এহসান-উদ-দৌলা

সুন্দরবনে প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বনের ক্ষেত্রে বিশ্বে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের ঘটনা। এর আগে ইন্দোনেশিয়া, পানামা, নাইজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও পুয়ের্তোরিকোতে এ রকম তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছিল। তবে এসব দুর্ঘটনার কোনোটাতেই পাঁচ-ছয় হাজার হেক্টরের বেশি এলাকায় তেল ছড়ায়নি।
আর গত তিন দিনে সুন্দরবনের প্রায় আট হাজার হেক্টর (৮০ বর্গকিলোমিটার) জায়গায় ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়েছে বলে বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
এর আগে যেসব দেশের শ্বাসমূলীয় বনে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার সবখানেই প্রথম দিন থেকেই তেল নিয়ন্ত্রণে প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। তার পরও ওই দেশগুলোতে বনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি এড়ানো যায়নি।
সুন্দরবনের আগে কাছাকাছি মাত্রার দুর্ঘটনা ঘটেছিল নাইজেরিয়ার উপকূলবর্তী নাইজার ব-দ্বীপে। ২০০৮ সালে সেখানে শেল কোম্পানির পাইপ থেকে তেল নিঃসরণের ফলে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে করে ধ্বংস হয় এক হাজার হেক্টর শ্বাসমূলীয় বন। আর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির শিকার হয় পাঁচ হাজার হেক্টর বনভূমি, যেটাকে লন্ডনভিত্তিক আইনি সংস্থা লেই ডে তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বিপর্যয় বলে আখ্যায়িত করে।
২০১৩ সালের মধ্যে বিশ্বে যতগুলো এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর উল্লেখ করে গত বছর একাধিক প্রতিবেদন ছেপেছে হাফিংটন পোস্ট ও গার্ডিয়ান পত্রিকা। সেখানে ক্ষয়ক্ষতির যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তা গত মঙ্গলবারের সুন্দরবনের বিপর্যয়ের তুলনায় কম।

বন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সুন্দরবনের পশুর, শ্যালা, রূপসা ও বলেশ্বর নদের ৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে। নদীতীরবর্তী এলাকার চাঁদপাই, জয়মনি, তাম্বুলবুনিয়া, হরিণটানা এলাকায় প্রায় তিন ধরনের বনজীবী বসবাস করেন। বন থেকে মাছ ও রেণু পোনা ধরা, মধু ও গোলপাতা আহরণ তাঁদের প্রধান জীবিকা। বনে তেল ছড়িয়ে পড়ার ফলে এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর জীবিকা ব্যাহত হচ্ছে।

.
.

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক তানজীমউদ্দিন খান সুন্দরবনের তেল বিপর্যয়ের ঘটনা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিপর্যয়টি বিশ্বের শ্বাসমূলীয় বনগুলোতে পরিবেশগত বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় ঘটনা। এ ধরনের বিপর্যয়ের পর বনের ক্ষতি যত দ্রুত কমিয়ে আনা যেত, ততই শ্বাসমূলীয় বনের জন্য মঙ্গলজনক হতো। কিন্তু বাস্তবে আমরা সে রকম কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না। এমনকি ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার করেছে কয়েকটি সাধারণ জাহাজ। আর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সত্ত্বেও তেল অপসারণে খালি হাতে কাজ করছে গ্রামের সাধারণ মানুষ।’
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ অবশ্য ডুবে যাওয়া জাহাজ উত্তোলনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকার বিষয়টাকে দায়ী করেছে। তারা বলছে, ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধারের জন্য উদ্ধারকারী বড় জাহাজ, তেল ছড়িয়ে পড়া রোধে রাবার বুম (একধরনের ভাসমান বাধা, যাতে তেল ছড়িয়ে পড়তে না পারে), স্কিমার, সরবেন্ট ম্যাটারিয়ালসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তাদের নেই। যে কারণে প্রথম দিন থেকেই তারা তাদের তৎপরতা শুরু করতে পারেনি।
এ বিষয়ে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মংলা বন্দর বন্ধ ছিল। ছয় বছর হলো এটা চালু হয়েছে। ফলে আমাদের যন্ত্রপাতিগুলো নেই। তবে এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আমাদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং যন্ত্র সংগ্রহের উদ্যোগ নেব।’
এ ব্যাপারে শ্বাসমূলীয় বনবিশেষজ্ঞ এবং সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের গবেষণা ফেলো আবু সাইদ প্রথম আলোকে বলেন, এ তেল বনের বৃক্ষের শ্বাসমূলে আটকে থাকবে। ফলে গাছ নিঃশ্বাস নিতে পারবে না এবং আক্রান্ত গাছগুলো মারা যাবে। গাছের পাতা খেয়ে বনের হরিণ বাঁচে। তেল লেগে যাওয়া পাতা কোনো হরিণ খেলে সেটি কিডনি অকার্যকর হয়ে মারা যেতে পারে। আক্রান্ত এলাকার ডলফিন, উদবিড়াল, গুঁইসাপ এবং সব ধরনের ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী আস্তে আস্তে মারা যাবে। ফলে এ বিপর্যয়ের ফলে পুরো এলাকার বনজীবী এবং প্রাণীর জীবন বিপন্ন হবে।
আগের বিপর্যয়: ১৯৮৬ সালে পানামার বাহিয়া লাস মিনাস অয়েল স্পিলের ঘটনাকে গবেষকেরা মহাবিপর্যয়কর হিসেবে চিহ্নিত করেন। ঘটনার পাঁচ বছর পরও গবেষকেরা বনে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত শ্বাসমূলের অস্তিত্ব দেখতে পান এবং লক্ষ করেন, বনের চারাগাছের বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৯২ সালের ইরা স্পিল ঘটনার চার বছর পরও বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার কোনো লক্ষণ খুঁজে পাননি গবেষকেরা।
১৯৮৪ সালে পানামায় ট্রপিকস স্পিল নামের একটি পরীক্ষামূলক তেল নিঃসরণ ঘটানো হয়। ঘটনার সাত মাস পর গবেষকেরা দেখতে পান, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ম্যানগ্রোভ বৃক্ষের মৃত্যুর হার ১৭ শতাংশ। ১০ বছর পর দেখা যায়, আক্রান্ত এলাকার অর্ধেক গাছই মৃত্যুবরণ করেছে।
তেল ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে কাজটি প্রথমেই করা জরুরি, তা হলো রাবার বুমের মাধ্যমে ভাসমান বাধা তৈরি করা, যাতে করে তেল ছড়িয়ে পড়তে না পারে এবং স্কিমার, সরবেন্ট ম্যাটারিয়ালসহ বিভিন্ন উপায়ে যত দ্রুত সম্ভব পানি থেকে তেল তুলে নেওয়া। যদি এ কাজগুলো দ্রুত শুরু করা না হয়, তাহলে একসময় ম্যানগ্রোভ বনের নদী-খালে তেল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন বিপন্ন করবে।