সামাজিক ব্যবসা হচ্ছে পরহিতকর: ইউনূস

ড. মুহাম্মদ ইউনূস
ড. মুহাম্মদ ইউনূস

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘সামাজিক ব্যবসা হচ্ছে পরহিতকর ব্যবসা, সমাজহিতকর ব্যবসা, যেখানে আমরা সমাজের অংশ হিসেবে সমাজের মঙ্গলের জন্য নিঃস্বার্থতার ভিত্তিতে কাজ করি। এখানে মুনাফা লাভের কোনো সুযোগ নেই।’
আজ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম ক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত সামাজিক ব্যবসা নিয়ে মতবিনিময় সভায় ড. ইউনূস এসব কথা বলেন। এর আয়োজন করে চট্টগ্রাম সামাজিক ব্যবসাকেন্দ্র লিমিটেড।
মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন চিটাগাং সোশ্যাল বিজনেস সেন্টারের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী, মতবিনিময় সভা আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক এম এ মালেক প্রমুখ।
ড. ইউনূস তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, সামাজিক ব্যবসায় দুটি জিনিস জরুরি। সৃজনশীলতা এবং ব্যবসায়িক ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান। সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে সাধারণ ব্যবসার পার্থক্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ব্যবসার ক্ষেত্রে আমরা উৎপাদন করি, বিক্রি করি মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে। এটা হচ্ছে ব্যক্তিহিতকর ব্যবসা। 

মতবিনিময় সভায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর বক্তব্যে সামাজিক ব্যবসার উৎপত্তি, বিকাশ এবং প্রয়োজনীয়তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।

সামাজিক ব্যবসার সূচনা যেভাবে
সামাজিক ব্যবসার সূচনা প্রসঙ্গে ইউনূস চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামের মানুষের জীবনচিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে চললেও এ অঞ্চলের গরিব ও মহিলাদের যেন অনেক সমস্যা। মনে শান্তি নেই। গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, তাদের বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে রাতের বেলায় চোখে দেখে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, এ রোগের নাম “নাইট ব্লাইন্ডনেস”। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে তারা চিরতরে অন্ধ হয়ে যাবে। এর প্রতিকারের জন্য তাদের ভিটামিন “এ” খাওয়াতে হবে। সবজি খেলে সে ঘাটতি পূরণ হবে। কারণ সবজিতে ভিটামিন “এ” রয়েছে। তখন আমরা ঠিক করলাম, গ্রামীণের উদ্যোগে সবজি চাষ করব। বাজার থেকে সবজির বীজ এনে মাত্র ১ টাকা দামের প্যাকেটে সবজি বিক্রি শুরু করলাম। গ্রামীণের লোকজন বিভিন্ন এলাকায় যাওয়ার সময় সঙ্গে করে বীজ নিয়ে যান। ফলে এটা পরিবহনের বাড়তি ঝক্কি পোহাতে হয়নি। এভাবে সবাইকে বাড়ির চারপাশে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করলাম। এভাবে ব্যবসা বড় হলো। একসময় আমরা দেশের অন্যতম বীজ ব্যবসায়ীতে পরিণত হলাম। বিএডিসি আমাদের বীজ দিতে পারছে না। তাই আমরা বীজ আমদানি শুরু করলাম। এভাবে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে গ্রামের মানুষ সবজি চাষ এবং বিক্রি করে সচ্ছলতা ফিরে পেল। তাদের ছেলেমেয়েদের অন্ধত্বের সমস্যারও সমাধান হলো।’

সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে চারটি চক্ষু হাসপাতাল
সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে গ্রামীণের উদ্যোগে প্রথমে ঢাকায় একটি চক্ষু হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। এখানে বছরে প্রায় ১০ হাজার ক্যাটারেক্ট রোগীর অপারেশন করা হয়। এরপর বরিশাল, ঠাকুরগাঁও এবং সাতক্ষীরায় অনুরূপ চক্ষু হাসপাতাল গড়া হয়। এসব অগ্রগতির বিষয় জানাতে গিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘ঢাকায় ও গ্রামগঞ্জের মানুষের কাছে শুনি ক্যাটারেক্ট সমস্যার কারণে অনেকেই ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। কারণ অপারেশনের জন্য ঢাকায়, নয়তো বিদেশে যেতে হয়। আমরা তখন একটি হাসপাতাল গড়ার উদ্যোগ নিই। চিকিৎসক, সেবিকা সবাইকে ভারতে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়। এখন দেশেই অত্যন্ত ভালোভাবে গরিব, বড়লোক সবাই উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। আমাদের লক্ষ্য ছিল, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে যে টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, তা ফিরে আসতে হবে। চার বছরের মধ্যে খরচ উঠে আসে। দ্বিতীয় হাসপাতালটির খরচ তিন বছরের মধ্যে উঠে আসে।’

নার্সিং কলেজ এবং অটোমেকানিক ট্রেনিং স্কুল
ড. ইউনূস জানান, সামাজিক ব্যবসার নীতি অনুসরণ করে ঢাকায় গড়ে তোলা হয়েছে একটি নার্সিং কলেজ এবং র‌্যাংগস ও জাপানি একটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলছে অটোমেকানিক ট্রেনিং স্কুল। গ্রামীণ ব্যাংকের শিক্ষা ঋণ নিয়ে নার্সিং কলেজে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। চাকরি পেয়ে তারা বেতনের এক-চতুর্থাংশ প্রদান করে ঋণ পরিশোধ করে দিচ্ছে। আগামীতে কলেজটিতে বিএসসি নার্সিং প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হবে বলে জানিয়েছেন নোবেলজয়ী ড. ইউনূস। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বে এক লাখেরও বেশি নার্সের চাহিদা রয়েছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এদের (নার্স) ব্যক্তিগত নাগরিকত্বের পাশাপাশি বাবা-মাকে সে দেশে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। অটোমেকানিক স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের জাপানি প্রতিষ্ঠানে সনদ দেওয়া হবে। এতে তাদের জন্য দেশের বাইরে চাকরির সুযোগ মিলবে অনায়াসে। এ ছাড়া চট্টগ্রামেও একটি নার্সিং কলেজ খোলার প্রস্তুতি চলছে।’

চাকরি করব না, দেব—এ মানসিকতায় তরুণদের এগোতে হবে
ইতিমধ্যে পাঁচ শতাধিক নবীন উদ্যোক্তা সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ব্যবসায়িক চাহিদা অনুযায়ী তিন লাখ, পাঁচ লাখ, দশ লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের পর শুধু মূল টাকাটা ফিরিয়ে দিলেই চলবে। এদের ব্যবসায়িক বিভিন্ন বিষয়ে নজরদারি হিসেবে প্রতিদিনের জমা-খরচের পাঁচটি তথ্য মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংককে জানানোর বিধান রয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নবীন উদ্যেক্তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলেন, ‘জীবনে চাকরি করব না, চাকরি দেব—এ মানসিকতা নিয়ে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশে অনেক তরুণ বেকার বসে আছে। পুঁজির অভাবে ব্যবসা করতে পারছে না। আমরা তাদের সহযোগিতায় প্রস্তুত আছি।’

বিদেশে সামাজিক ব্যবসা
বর্তমানে ভারত, কলম্বিয়া, হাইতি, ব্রাজিল, তিউনিসিয়া, উগান্ডা প্রভৃতি দেশে সামাজিক ব্যবসা চালু রয়েছে বলে ড. মুহাম্মদ তাঁর বক্তব্যে জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্বের অন্যতম কফি উৎপাদনকারী দেশ কলম্বিয়ার দৃষ্টান্ত টেনে ড. ইউনূস বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ বাজার দখল করে নেওয়ায় এখানকার কফি-শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়েন। কলম্বিয়ার অর্থনীতিতে ধস নামে। তারা এ বিষয়ে আমার সহযোগিতা চাইলে বিশ্বখ্যাত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই উৎপাদনকারী কানাডার মিখখেইন কোম্পানির সহযোগিতায় সামাজিক ব্যবসার নীতি অনুসরণ করে কফি-শ্রমিকদের আলু উৎপাদনে নিয়োজিত করা হয়। এর ফলে দ্রুত পাল্টে যায় এসব মানুষের জীবনচিত্র।’