তাঁদের আলো ছড়ানোর অভিযান

এডু আলো বিদ্যালয়ে পড়ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা  প্রথম আলো
এডু আলো বিদ্যালয়ে পড়ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা প্রথম আলো

‘সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা হবে শিক্ষিত, বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার হবে শতভাগ’-স্বপ্নটা বহুদিন ধরে লালন করছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাইমুম রেজা। কিন্তু কীভাবে কী করবেন সেটি ভাবতে ভাবতেই খোঁজ পান এডু আলো ফাউন্ডেশনের। স্বপ্ন বাস্তবায়নের সঠিক রাস্তাটা চিনিয়ে দেন তাঁরা সাইমুমকে।
সাইমুমের মতো কয়েকজন তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় এডু আলো ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গড়ে ওঠে এডু আলো বিদ্যালয়। নগরের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় অবস্থিত ছিন্নমূল শিশুদের এই বিদ্যালয়ে এখন ৩৫ শিশু লেখাপড়া করছে। কেবল চট্টগ্রাম নয়, দেশের আরও কয়েকটি জেলায় তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে এডু আলো প্রতিষ্ঠা করেছে ছিন্নমূল শিশুদের জন্য বিদ্যালয়। স্বপ্ন একটাই। দূর করতে হবে নিরক্ষরতার অন্ধকার।
বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভাড়া নেওয়া একটি কক্ষে চলছে এডু আলো বিদ্যালয়ের আলোর অভিযান। দিনটি ছিল ২০১২ সালের ৩০ জুন। বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে খুঁজে আনা হয় ৩০ জন ছিন্নমূল শিশুকে। এক বছরে যোগ হয়েছে আরও পাঁচজন শিক্ষার্থী। ১৬ জন স্বেচ্ছাসেবী তরুণ এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। বিদ্যালয় পরিচালনার খরচ ওঠাতে মাসে মাসে ১০০ টাকা করে চাঁদাও দেন তাঁরা। বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার পদ্ধতিটাও ভিন্ন। খেলতে খেলতে শিশুরা যাতে সহজেই শিখতে পারে, এমনভাবে সাজানো হয়েছে পাঠক্রম।
সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, একটি ছোট কক্ষে দেয়ালে ঝোলানো সাদা বোর্ডে মার্কার দিয়ে বর্ণমালা লিখছেন শিক্ষিকা। শিক্ষিকার সঙ্গে শিশুরা সেই বর্ণমালা সুর করে উচ্চারণ করে খাতায় লিখছে। লেখা শেষ হতেই হাততালিতে মুখর হলো কক্ষ। এমন আনন্দ উচ্ছ্বাস নিয়েই পড়াশোনা করে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয়টির বর্তমান সমন্বয়কারী কাইয়ুম আহমেদ জানালেন, এডু আলো ফাউন্ডেশনের নিজস্ব একটি শিক্ষা পদ্ধতি রয়েছে। পদ্ধতিটির নাম ‘কুইক লার্নিং প্রোগ্রাম’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আহসানুল হক এর আবিষ্কারক। এই পদ্ধতিতে খুব দ্রুত যেকোনো অক্ষরজ্ঞানহীনকে অক্ষর চেনানো যায়।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পিংকি আক্তারের বয়স আট বছর। ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছে সে। একসময় ভিক্ষা করতে হতো দুবেলা খাবার জোগাড় করতে। তাঁর হাতে এখন ভিক্ষার পাত্রের বদলে শোভা পাচ্ছে বই-খাতা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবক জাকিয়া কবির বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বয়স ছয় থেকে ১২-এর মধ্যে। এদের পড়াতে এক ধরনের ভালোলাগা কাজ করে।’
সপ্তাহের শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত পাঠদান চলে বিদ্যালয়ে। এখানে শিশু শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। এরপর শিশুদের ভর্তি করানো হয় কাছের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বইখাতাসহ সব শিক্ষা উপকরণ মেলে বিনা মূল্যে। পড়ালেখার পাশাপাশি ১৫ দিন অন্তর পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। পাঠ্যবইয়ের বাইরে শিক্ষার্থীদের জন্য চালু আছে সহশিক্ষা কার্যক্রম। বিদ্যালয়ে নিয়মিত পাঠদান করেন তাসলিমা আক্তার নামের একজন শিক্ষিকা। তবে প্রতিদিন পালাক্রমে স্বেচ্ছাসেবকদের দুইজন এসে পাঠদান করেন এবং তদারকি করেন সব কার্যক্রমের। বিদ্যালয় পরিচালনার অর্থের একটা অংশ জোগান দেয় এডু আলো ফাউন্ডেশন। সম্প্রতি খরচ জোগাতে এগিয়ে এসেছে রোটারি ক্লাব অব চট্টগ্রাম মহানগর।