রংপুরের আলবদর নেতা আজহারুল ইসলামের ফাঁসি

রায় ঘোষণার পর কারাগারে নেওয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হচ্ছে আজহারুল ইসলামকে l ছবি: প্রথম আলো
রায় ঘোষণার পর কারাগারে নেওয়ার জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হচ্ছে আজহারুল ইসলামকে l ছবি: প্রথম আলো

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন রংপুরের আলবদর নেতা। তাঁর নেতৃত্বে ও সহযোগিতায় আলবদর, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা রংপুরে এক দিনে ১ হাজার ২০০ মানুষকে হত্যা করে, গণহত্যা চালায় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ওপর। এসব অপরাধের দায়ে আজহারুলকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়, আজহারুলের বিরুদ্ধে গঠন করা ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে গণহত্যা, হত্যা ও অগ্নিসংযোগের তিনটি অভিযোগে তাঁকে সর্বোচ্চ সাজা (মৃত্যুদণ্ড) দেওয়া হয়। আর ধর্ষণ, অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের দুটি অভিযোগে তাঁকে মোট ৩০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। তবে মৃত্যুদণ্ডের একটি সাজা কার্যকর হলে বাকি সাজাগুলো এর সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে। প্রমাণিত না হওয়ায় হত্যার একটি অভিযোগ থেকে তিনি খালাস পান।
এ নিয়ে দুটি ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৫টি মামলার রায় দিলেন। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-১ সাতটি ও ট্রাইব্যুনাল-২ আটটি মামলার রায় দিয়েছেন। দুই ট্রাইব্যুনালে আরও একটি করে মামলা রায়ের অপেক্ষায় আছে।
রায় ঘোষণার দিন ধার্য থাকায় গতকাল সকালে ৬২ বছর বয়সী আজহারুলকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। বেলা ১১টার দিকে তাঁকে এজলাসে আসামির কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। মিনিট দশেক পর আসন নেন ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারপতি।
শুরুতে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, ফৌজদারি মামলায় সব পক্ষকে খুশি করে রায় দেওয়া সম্ভব নয়। বিচারকেরা সংবিধান, আইন ও সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে রায় দেন। রায়ে যে পক্ষই সংক্ষুব্ধ হন, তাঁদের উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ আছে। তবে রায় পছন্দ না হলে রায়ের বিরুদ্ধে সহিংস কর্মসূচি দেওয়া আশা করা যায় না। আবার বিশেষ ধরনের রায় দেওয়ার জন্য বিচারকদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করাও কাম্য নয়। দেশের দু-একটি ও কয়েকটি বিদেশি গণমাধ্যম এমনভাবে প্রতিবেদন করে, যেন ট্রাইব্যুনাল এ দেশের ধর্মীয় নেতাদের বিচার করছেন। কিন্তু বিচার করা হচ্ছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের, কে কোন দল করেন সেটা ট্রাইব্যুনালের দেখার বিষয় নয়। সম্পাদকীয় লিখে, বিবৃতি দিয়ে রায় পরিবর্তন করা যায় না। রায় পরিবর্তন করতে হলে সংক্ষুব্ধ পক্ষকে আপিলের মাধ্যমে প্রতিকার চাইতে হয়।
এরপর ১৫৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনাল। রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, সরকারের উচিত মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস স্কুল ও কলেজের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। এ ছাড়া বীরাঙ্গনারা যাতে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পান, সরকারের উচিত দ্রুত তার ব্যবস্থা করা।
তিন অভিযোগে ফাঁসি: দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আজহারুলকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।
দ্বিতীয় অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ১৬ এপ্রিল আজহারুলের নেতৃত্বে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ধাপপাড়ার ১৫ জন নিরস্ত্র বাঙালিকে গুলি করে হত্যা ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, ১৭ এপ্রিল বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ার বিল এলাকায় প্রায় এক হাজার ২০০ মানুষকে হত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে এই নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে আজহারের নেতৃত্বে রাজাকাররা অংশ নেয়। চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, আজহারের সহযোগিতায় একাত্তরের ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা রংপুর কারমাইকেল কলেজের চার শিক্ষক কালাচাঁদ রায়, সুনীল বরণ চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ অধিকারী ও চিত্তরঞ্জন রায় এবং কালাচাঁদ রায়ের স্ত্রী মঞ্জুশ্রী রায়কে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অপহরণ করে দমদমা সেতুর কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যা ও অগ্নিসংযোগ এবং চতুর্থ অভিযোগে গণহত্যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
দুই অভিযোগে ৩০ বছর কারাদণ্ড: পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগে অপহরণ, আটক রাখা, নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আজহারকে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে পঞ্চম অভিযোগে ২৫ বছর ও ষষ্ঠ অভিযোগে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আজহারের উসকানিতে পাকিস্তানি সেনারা এক নারীকে রংপুরের টাউন হলে নিয়ে ১৯ দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পাকিস্তানি সেনা, আলবদর ও রাজাকাররা বিভিন্ন স্থান থেকে নারী-পুরুষদের অপহরণ করে টাউন হলে আটকে রেখে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালাত। পাকিস্তানি সেনাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার ওই নারী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
ষষ্ঠ অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের নভেম্বরের মাঝামাঝি আজহারুলের নেতৃত্বে আলবদর ও রাজাকাররা রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ার এক ব্যক্তিকে নির্যাতন এবং ১ ডিসেম্বর শহরের বেতপট্টি থেকে এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে রংপুর কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করে।
এক অভিযোগ থেকে খালাস: প্রথম অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন আজহার। এ অভিযোগ অনুসারে, আজহারের নেতৃত্বে রাজাকাররা একাত্তরের ২৪ মার্চ থেকে ২৭ মাচের্র মধ্যে রংপুরের এক আইনজীবীসহ ১১ জনকে অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতন করে। ৩ এপ্রিল তাঁদের শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি।
রাষ্ট্রপক্ষের আরজি ছিল, আজহারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে ধর্ষণের শিকার নারীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে ট্রাইব্যুনালের আইনে সুনির্দিষ্ট বিধানের অভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেননি ট্রাইব্যুনাল।
ফাঁসির সাজা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আসামির কাঠগড়ায় বসা এ টি এম আজহার দাঁড়িয়ে বলেন, ‘ফরমায়েশি রায়, ফরমায়েশি রায়, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।’ বিচারকদের দিকে আঙুল তুলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আপনাদের বিচার করবে।’
প্রতিক্রিয়া: আজহারুলের ফাঁসির রায়ে সন্তোষ জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করবেন। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের গুণগত মানের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই মানের সাক্ষ্য দিয়ে ফৌজদারি মামলা প্রমাণ করা যায় না।