প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে নতুন চিন্তা

.
.

জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (প্রাশিস) পরীক্ষায় এবার আগের বছরের তুলনায় ফল খারাপ হয়েছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার কারণেই মূলত জেএসসির সার্বিক ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
আবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে পুরো ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে আগামী বছর থেকে সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগে আগে স্থানীয় পর্যায়ে ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার শুরুর দিন থেকেই ফাঁস হয় বলে ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। এই পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ-৫—দুটিই কমেছে। জিপিএ-৫ কমেছে ১৬ হাজার ৫৫০ জন। পাসের হার ৯৭ দশমিক ৯২ শতাংশ হলেও এবারের পরীক্ষায় ব্যাপকভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে এ ফলও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন একাধিক শিক্ষক। গতবারও এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। এসব কারণে এ পরীক্ষায় ভালো ফল করেও মানুষের আগ্রহ কম।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এবারের প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও তাঁরাও মনে করেন ‘কিছু একটা’ হয়েছে। কিন্তু বিশালসংখ্যক পরীক্ষার্থী নিয়ে অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষা নতুন করে নিতে গেলে বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে হবে। এ কারণে শুরু থেকেই তাঁরা বিষয়টিকে প্রকাশ্যে গুরুত্ব দেননি। তবে আগামী বছর থেকে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে জন্য করণীয় নির্ধারণে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা। ইতিমধ্যে এ নিয়ে তাঁরা দুটি বৈঠক করেছেন।
মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলেছে, আগামী বছর থেকে ‘ডিজিটাল’ ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে পরীক্ষার আগের দিন কিংবা পরীক্ষার দিন সকালে জেলা প্রশাসকদের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় পর্যায়ে প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্রের একাধিক সেট ঠিক করে সেখান থেকে পরীক্ষার আগমুহূর্তে এক বা একাধিক সেট প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে তা দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হবে। আরেকটি বৈঠক করে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
গতকাল ফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানও এ ধরনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান। তবে মন্ত্রী এ বিষয়ে গতকাল বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষাপদ্ধতি কলুষমুক্ত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। আগামী বছর থেকে কথা বলার সুযোগ থাকবে না।’
ঢাকা বোর্ডের খারাপ ফল: জেএসসির ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা গতবারের চেয়ে নয় হাজার ৩৫ জন কম। ২০১০ সালে জেএসসি চালুর পর থেকে যেখানে প্রতিবছরই এই বোর্ডে জিপিএ-৫ বেড়েছে, সেখানে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে নয় হাজারের বেশি কমে যাওয়ার ধাক্কাটি লাগে মোট পরীক্ষার ফলে। এবার জেএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৫২ জন কমে গেছে। এর মধ্যে ঢাকা বোর্ডেই অর্ধেকের বেশি কমেছে।
গতবার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৫৫ হাজার ২২৩ জন, সেখানে এবার কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ১৮৮ জন। শুধু জিপিএ-৫ নয়, পাসের হারও এই বোর্ডে প্রায় আড়াই শতাংশ কমে গেছে। এবার এই বোর্ডে পাসের হার ৮৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গতবার এ হার ছিল ৮৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এবার জেএসসিতে মোট পাসের হার প্রায় গতবারের মতোই।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এবারই প্রথমবারের মতো কঠিন বিষয় হিসেবে পরিচিত গণিতের পরীক্ষায় সৃজনশীল চালু করা হয়েছে। আবার নতুন বিষয় হিসেবে চারু ও কারুকলা চালু করা হয়েছে। নতুন বিষয়ে বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় পড়েছে। এ বিষয়গুলোর সঙ্গে ইংরেজিতেও শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে খারাপ ফল করেছে বলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সূত্রে জানা গেছে। তবে বিষয়ভিত্তিক ফলাফলের বিষয়টি এবার আর তাঁরা প্রকাশ করেননি। গতকাল পর্যন্ত বিষয়টি গোপন রাখা হয়।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব শাহেদুল খবীর চৌধুরী মনে করেন, এর কিছুটা প্রভাব পড়ে থাকতে পারে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, গণিতে সৃজনশীল চালুর কারণে হয়তো কিছুটা খারাপ হতে পারে। তবে এটা খুব সমস্যা নয়। এটা হতেই পারে।
এবার জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক বছর বেশি জিপিএ-৫ নিয়ে নানা কথা উঠেছে। তিনি নিজেও টক শোতে এ নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর ধারণা, এসব কারণে হয়তো এবার শিক্ষকেরা খাতা দেখায় আগের চেয়ে কম উদারতা দেখিয়েছেন। জিপিএ-৫ তাই কমতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরাও চাই শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করুক, তবে সেটা যেন যোগ্যতা অনুযায়ী হয়।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. কায়কোবাদ ডিজিটাল ব্যবস্থায় পরীক্ষার আগ মুহূর্তে প্রশ্নপত্র ছাপানোর উদ্যোগকে ইতিবাচক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে একাধিক সেট প্রশ্নপত্র তৈরিরও প্রয়োজন নেই। এক সেট প্রশ্ন দিয়েও তা করা সম্ভব।